অমিতাভ মিত্র : আপনার শৈশবের দিনগুলো, স্কুল জীবনের শুরুর প্রভাবগুলো সম্পর্কে বলুন যা সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ তৈরি করেছিল। আমি মনে করি বেশিরভাগ কবি এবং লেখকের মধ্যে একটি সাধারণ প্রবণতা থাকে—একটি পরিবেশ, কিছু ব্যক্তি এবং এমনকি কিছু ঘটনা—যা তাদের লেখালেখির জগতে ঠেলে দেয়।
সাহার রিজভি : আমি আমার পরিবারের সবচেয়ে ছোট সদস্য ছিলাম, আমার পরবর্তী ভাইবোনের সাথে আমার বয়সের পার্থক্য ছিল ১৫ বছর। ফলে আমি বড় হয়েছি প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে, এবং প্রাপ্তবয়স্কদের সাহিত্য পড়েই আমার বেড়ে ওঠা। স্কুল ছাড়া অন্য কোথাও আমার বয়স-অনুপযোগী বই পড়া হয়নি, আর স্কুলের বইগুলো বেশিরভাগ সময় আমাকে বিরক্ত করত।
আমার স্কুলগুলো ছিল ব্রিটিশ পাঠ্যক্রম দ্বারা প্রভাবিত বা তার অংশ। তাই আমরা পড়তাম শেক্সপিয়ার, জে. আর. আর. টলকিয়েন, রোয়াল্ড ডাল, আর আমার কাজিনের বিতর্কিত রোমান্স উপন্যাস। আমি খুব দ্রুত বড় হতে চেয়েছিলাম, সেইসব সূক্ষ্ম ইঙ্গিত বুঝতে চাইতাম যা প্রাপ্তবয়স্ক সাহিত্যের মর্ম বোঝার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াত। একই সঙ্গে আমি হতাশ হই যে, এসব গল্পে কোনো চরিত্রই আমার মতো নয়। প্রায় সব চরিত্রই ছিল সাদা, আর তাদের উদ্বেগ আমাকে তুচ্ছ ও অপ্রাসঙ্গিক মনে হতো।
আমার বাবা যেসব ঐতিহাসিক, অভিযাত্রী বা যুগনাট্যধর্মী বই পড়তেন, তার প্রতি আমার গভীর আগ্রহ ছিল। তিনি প্রায়ই জর্জ বি. শ্যালারের “Stones of Silence” এর মত বই থেকে উদ্ধৃতি পড়তেন এবং তাঁর শৈশবকালের ব্রিটিশ ভারতে সংগৃহীত নানা বই থেকে গল্প শোনাতেন। তাঁর এই বইপড়ার রুচির আমার জীবনে গভীর প্রভাব পড়ে।
১৫-১৮ বছর বয়সে আমি একপ্রকার বই পড়া ছেড়ে দিই, কারণ আমি আর ইংল্যান্ড-ভিত্তিক উপন্যাস পড়তে পারছিলাম না। সবকিছুতেই ইংল্যান্ড! এই উপন্যাসগুলো আমাকে আমার স্কুল বাধ্য করত পড়তে—যেমন চার্লট ব্রন্টের Jane Eyre। সেই জোর করাটা আমার মধ্যে এক ধরনের বিদ্রোহ জন্ম দেয়। এটা সাহিত্যবিরোধিতা ছিল না, বরং বাধ্যতামূলকতা বিরোধিতা।
আমাদের পারিবারিক গ্রন্থাগারে আমি একদিন একটি বই পাই—সারা সুলেরির ‘Meatless Days’—এই বইটি আমার সাহিত্য নির্বাচনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। তখন আমি প্রথম দক্ষিণ এশীয় নারীদের বয়ান সম্পর্কে জানতে পারি, এবং এরপর থেকেই আমি এমন লেখকদের খুঁজতে শুরু করি যাদের সাংস্কৃতিক ও জাতিগত পরিচয় ছিল গভীর।
আমার সাহিত্যর প্রতি আসক্তি সত্যিকার অর্থেই তখন শুরু হয়, যখন আমি বাড়ি ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই। সেখানে আমি আবিষ্কার করি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, মনিজা আলভি, আঘা শহিদ আলী, সাদাত হাসান মান্টো, মহসিন হামিদ, রুমি, খালিল জিবরান প্রমুখকে।
আমার মধ্যে প্রবাসী লেখকদের এমন কণ্ঠ খোঁজার এক প্রবল ইচ্ছা ছিল—যাঁরা ইতিহাস, সংস্কৃতি, “বাড়ি” নামক অস্থিরতা ও নিঃসঙ্গতা নিয়ে লেখেন। এমন কণ্ঠ যা আমি অনুভব করতে পারি। আর এটাই আমাকে আমার নিজের বয়ানের সাথে স্বস্তিতে আনতে সাহায্য করেছে।
অমিতাভ মিত্র: সত্তরের ও আশির দশকের পাকিস্তানে সাহিত্যিক পরিবেশ কেমন ছিল?
সাহার রিজভি : আমি আশির দশকের সন্তান, এবং পাকিস্তানে দীর্ঘ সময় থাকিনি যাতে সেই সময়ের সাহিত্যিক পরিবেশে ডুবে যেতে পারি। তাই খুব তথ্যভিত্তিকভাবে এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না।
তবে আমি এটুকু বলতে পারি, পঞ্চাশের দশকের লেখক সাদাত হাসান মান্টো আমাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছেন। মান্টোর শক্তিশালী লেখনীশৈলী এবং সাহসী, রাজনৈতিক বিষয় নির্বাচন ছিল সেই সময়ের সামাজিক ভাষ্যকারদের জন্য খুবই ব্যতিক্রম।
তাঁর মধ্যে ছিল দারুণ রসবোধ—যা সে সময়ের প্রতিষ্ঠিত লেখকদের মধ্যে দেখা যেত না—আর এটিই আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। তাঁর এই অদ্ভুততা ছিল আকর্ষণীয়, যার মাধ্যমে আমি আমার নিজস্ব সংস্কৃতির মধ্যে লেখকদের বৈচিত্র্য আবিষ্কার করি।
আমি তাঁর মতো লেখকদের অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখি, যারা সমাজ যাকে ‘সঠিক’ বলে ধরে নেয়, তাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। উপমহাদেশ গত শতাব্দী জুড়ে অস্থিরতায় ভরা ছিল, তাই আশ্চর্য লাগে কেন আরও বেশি এমন বয়ান তৈরি হয়নি। মান্টোর লেখাকে আমি এজন্যই মূল্য দিই—তিনি একজন পাকিস্তানি লেখক হিসেবে ব্যতিক্রম।
অমিতাভ মিত্র : পাকিস্তানের প্রতিটি শহরের নিজস্ব সাহিত্য ও সংস্কৃতি রয়েছে, যেটি লেখকেরা স্বতন্ত্রভাবে আগলে রাখেন। আপনি কীভাবে বিভিন্ন প্রান্তের সাহিত্যকে আত্মস্থ করলেন?
সাহার রিজভি : আমার শহর, করাচি, সবচেয়ে ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যায় “বিশৃঙ্খল” হিসেবে। এর সৌন্দর্য দৃষ্টিনন্দন নয়, বরং চরিত্রে সুন্দর। এই শহরের বিশাল জনগণের বৈচিত্র্য আমাকে অনুপ্রাণিত করে। ধনী ও গরিবের মাঝে এমন বৈষম্য বিদ্যমান, যেখানে সৌন্দর্য হয়ে ওঠে মানসিক ধারণা—আপনি যেভাবে দেখতে চান, সেভাবেই সৌন্দর্য খুঁজে পান।
বর্তমানে অনেক লেখক করাচি নিয়ে লেখেন, যেমন কামিলা শামসি। তবে তারা অনেক সময় মিস করেন বাস্তবতাকে—এমন পাঠক মাত্রই উপভোগ করতে পারেন যারা পাকিস্তানের উচ্চবিত্ত শ্রেণির। তাই আমি আমার অনুপ্রেরণা পাই গল্প থেকে, খবরের কাগজ পড়ে, টিভি সংবাদ দেখে—যেগুলো আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। একজন পাকিস্তানি হিসেবে সেসব গল্প না লিখে থাকা কঠিন। আমি এই গল্পগুলোকে আমার দৃষ্টিকোণ থেকে বলি, সেগুলো আমার কাছে খুবই ব্যক্তিগত। তারা আমাকে নাড়া দিয়েছে।
অমিতাভ মিত্র : আপনি কি উর্দুতেও লেখেন? কোন ভাষায় আপনি সবচেয়ে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
সাহার রিজভি : না, আমি উর্দুতে লিখি না কারণ আমি কেবল মৌখিকভাবে উর্দুতে সাবলীল। আমি ইংরেজিতেই সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি, কারণ আমি ইংরেজিতেই ভাবি এবং আমি জীবনের বেশিরভাগ সময় ইংরেজিভাষী দেশেই কাটিয়েছি। অবশ্য কিছু শব্দ ও অভিজ্ঞতা কেবল মাতৃভাষায়ই ব্যক্ত করা যায়—তাদের কোনো ইংরেজি প্রতিশব্দ নেই। সেইসব শব্দের অনুবাদ অসম্ভব, এবং উর্দুতে তাদের যে আবেদন থাকে, তা ইংরেজিতে হারিয়ে যায়।
অমিতাভ মিত্র : আমি নিশ্চিত, আপনি নিশ্চয়ই উর্দু থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করার চেষ্টা করেছেন। আমি চেষ্টা করেছি কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি, কারণ আমি মূল রূপের সৌন্দর্য ও মর্ম ধরে রাখতে পারিনি। আপনি কি একইরকম অনুভব করেন?
সাহার রিজভি : আমি উর্দু কবিতার অনুবাদ করেছি, তবে তা ছিল অত্যন্ত সরল ও রেখাসমতা অনুসরণকারী শৈলীতে। আসলে এখানে সৌন্দর্য স্থানান্তরিত হয়নি, এমনটা নয়—বরং বিষয়ভিত্তিক তাৎপর্য বা আবেগের গভীরতা ঠিকঠাক অনুবাদ করা সম্ভব হয়নি।
উর্দু কবিতার যে ঘরানাগুলো প্রচলিত, তাদের কাঠামোগত কঠোরতা অনুসরণ করে শব্দের মাধ্যমে ইতিহাসের রূপরেখা ফুটিয়ে তোলা অত্যন্ত দুরূহ। ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের যন্ত্রণাকে শব্দে ধরতে গেলে দরকার হয় সেইসব পারিবারিক গল্পগুলোর, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে উত্তরাধিকার হিসেবে চলে এসেছে।
আমি যেসব লেখা অনুবাদ করার চেষ্টা করেছি, তার বেশিরভাগই একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে রচিত—আর তাই মূল বয়ানের অন্তর্নিহিত অভিপ্রায়কে যথাযথভাবে তুলে ধরতে পারিনি।
তবে এমন অনেক রচনাও আছে, যেগুলো দক্ষ ও অভিজ্ঞ লেখকদের হাতে অনূদিত হয়ে গজল কিংবা মার্সিয়া ধারার কাব্যিক রূপকে সফলভাবে অনুকরণ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত, আমি এখনও সেই পর্যায়ের পেশাদারিত্বে পৌঁছাইনি যে আমি নিজে এমন একটি সাহসী প্রয়াসে হাত দিতে পারি।