গাজায় জন্ম, বর্তমানে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী সাংবাদিক আহমেদ আলনাউক ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিজের ২০ জনেরও বেশি পরিবারের সদস্যকে হারিয়েছেন। তিনি একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তরুণ ফিলিস্তিনিদের লেখা সংকলিত করে একটি নতুন বই প্রকাশ করেছেন।
“গাজা, তোমাকে এই অবস্থায় দেখা হৃদয় বিদারক” — তরুণ ফিলিস্তিনি লেখকদের তিনটি গল্প
২২ অক্টোবর ২০২৩-এ, ইসরায়েলি এক বিমান হামলায় গাজার কেন্দ্রীয় শহর দেইর আল-বালাহতে আহমেদ আলনাউকের বাসায় আঘাত হানে, নিহত হন তার পরিবারের ২১ জন সদস্য—৭৫ বছর বয়সী বাবা, দুই ভাই, তিন বোন ও তাদের সব সন্তানসহ।
তখন তিনি লন্ডনে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী হিসেবে কাজ করছিলেন। “আমার ভেতরটা ভেঙে গিয়েছিল,” বললেন তিনি। নিজের বাসায় ফিরতে না পারায় তিনি শুধু দূর থেকে অসহায়ভাবে দেখেছেন ও একাকী শোক করেছেন। পরে জানান, তাকে এখন সবচেয়ে বেশি তাড়িয়ে বেড়ায় ক্ষোভ নয়, বরং বেঁচে থাকার অপরাধবোধ। “সব সময় মনে হয়, কেন? কেন আমি বেঁচে আছি? কেন আমি আমার পরিবারের সঙ্গে মারা যাইনি?”
তিনি মনে করেন, তার জীবিত থাকার একমাত্র কারণ হলো—তাদের গল্প বিশ্বকে বলা।
“তাদের গল্পগুলো আমাদের বলতে হবে”
আট বছর আগে, ২০১৪ সালের গ্রীষ্মে সাত সপ্তাহের গাজা যুদ্ধের সময় এক বিমান হামলায় তার বড় ভাই আইমান ও তার চার বন্ধুর মৃত্যু হয়। সেই ঘটনার পর আহমেদ তরুণ ফিলিস্তিনিদের জন্য একটি অনলাইন প্ল্যাটফর্ম সহ-প্রতিষ্ঠা করেন, যাতে তারা নিজেদের জীবনের গল্প আন্তর্জাতিক অডিয়েন্সের জন্য লিখতে পারে।
“তখন আমার মনে হয়েছিল, সব পশ্চিমা মানুষ ফিলিস্তিনিদের পছন্দ করে না। তারা আমাদের গল্প পড়তে চায় না,” বলছিলেন তিনি। “কিন্তু আমি ভুল প্রমাণিত হলাম।”
লন্ডনের অফিস থেকে নরম স্বরে তিনি বলেন, “আমি গভীর হতাশায় ডুবে গিয়েছিলাম। আমি সত্যি বলতে চাইছিলাম মারা যেতে, যেন আমার ভাইয়ের সঙ্গে থাকতে পারি।”
এরপর গাজায় পরিচিত একজন আমেরিকান সাংবাদিক পাম বেইলি তাকে ফেসবুকে বার্তা পাঠান। আহমেদ প্রথমে “আমি ঠিক আছি” বলেন। কিন্তু বেইলি জোর দেন, “না, সত্যি বলো। কেমন লাগছে ভাইকে হারিয়ে?” তখন তিনি খোলামেলা বলেন, “আমি একেবারে ভেঙে পড়েছি। দিনের বেশিরভাগ সময় আমি ভাইয়ের কবরে কাটাই। একা থাকলেই কাঁদি।” পাম তাকে প্রস্তাব দেন ইংরেজিতে ভাইয়ের একটি গল্প লিখতে। “প্রথমে না করে দিই। আমার ইংরেজি ভালো ছিল না।” কিন্তু পরে রাজি হন। তিন মাস ধরে লেখা, সম্পাদনা আর পর্যালোচনার পর সেই গল্পটি প্রকাশ করা হয়।

“সেই অভিজ্ঞতা আমার জীবন পাল্টে দেয়,” বলেন আলনাউক। “প্রথমবারের মতো গাজার বাইরের মানুষদের কাছ থেকে সহানুভূতির বার্তা পাই। আমার আত্মবিশ্বাস ফিরে আসে।”
এরপর তারা ভাবেন—“যদি এই অভিজ্ঞতা আমার জন্য কাজ করে, তাহলে আমরা অন্য ফিলিস্তিনিদের জন্যও এটা করতে পারি না কেন?”—এই ভাবনা থেকেই জন্ম নেয় We Are Not Numbers (আমরা শুধু সংখ্যা নই) নামের প্ল্যাটফর্ম।
২০১৫ সালে এটি শুরু হয় মাত্র ২০ জন তরুণ লেখকের সঙ্গে, যাদের মধ্যে অনেকেই ইংরেজি সাহিত্য পড়তেন। বিশ্বজুড়ে স্বেচ্ছাসেবক মেন্টর তাদের সহায়তা করতেন। লেখকরা বর্ণনা করতেন বোমা হামলা, ভয়, বেদনা—তবে শুধু তা-ই নয়; তারা লিখতেন গাজার সৌন্দর্য নিয়েও।
“আমরা তাদের উৎসাহ দিতাম গাজার বন্ধুসুলভ, অতিথিপরায়ণ মানুষের কথা, সংস্কৃতি, মসজিদ, গির্জা, কবরস্থান—সবকিছুর কথা লিখতে,” বলেন আলনাউক। “এই কাজটা শুধু থেরাপি নয়, এটা ছিল গাজার প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেওয়ার এক প্রচেষ্টা।”
গল্পগুলো এখন বইয়ে
প্ল্যাটফর্মটি দ্রুত জনপ্রিয়তা পায়। প্রতি ছয় মাসে নতুন ২০-৩০ জন লেখক যুক্ত হতেন। গত ১০ বছরে ১,৫০০-এর বেশি গল্প ও কবিতা প্রকাশ করেছে WANN।

ছবি: আহমেদ আলনাউক।
সম্প্রতি, তারা গত এক দশকের ৭৪টি শ্রেষ্ঠ গল্প একত্র করে একটি বই প্রকাশ করেছে:
We Are Not Numbers: The Voices of Gaza’s Youth।
নাওমি ক্লেইন বইটিকে বলেছেন “একটি অলৌকিক কারাগারভাঙা,” এবং রিজ আহমেদ বলেছেন, “পড়া বন্ধ করা বা ভুলে যাওয়া অসম্ভব।”
বইতে প্রতিটি অধ্যায় একটি বছর নিয়ে, যেখানে বড় ঘটনাগুলো ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিতে বলা হয়েছে। ২০১৫ সালে নাদা হাম্মাদ লেখেন: “ধূসর ক্যানভাসের মাঝে ধীরে ধীরে রঙ ফুটে উঠছে—সাদা দেয়াল, গৃহস্থালি শিবিরে গ্রাফিতি। এটা ছিল বেঁচে থাকার ঘোষণা, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা নয়।”
“আমরা ইতিহাস লিখছি, মানবিকভাবে”
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার সময় আলনাউক যুক্তরাজ্যে ছিলেন। সেসময় তিনি WANN-এর আন্তর্জাতিক পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন এবং সামাজিক মাধ্যমে সরাসরি নিজের পরিবারের ক্ষয়ক্ষতির কথা জানান। “এই বোমা হামলার পর আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় যাই, এবং ব্যাপক প্রতিক্রিয়া পাই। তখন ভাবি—এটাই সময়। শুধু অনলাইনে নয়, বইয়ের মাধ্যমেও আমাদের গল্প পৌঁছে দিতে হবে।”
তার ভাই মাহমুদসহ অক্টোবর ২০২৩-এর পর WANN-এর চারজন লেখক গাজায় নিহত হয়েছেন।
“এটা আমাদের দায়িত্ব যে আমরা তাদের গল্প কাগজে লিখে অমর করে রাখি।”
বর্তমানে যুদ্ধ চললেও গাজার তরুণরা লেখা থামায়নি—বরং আরও বেশি লিখছে। “এখন আমরা আগের চেয়ে তিনগুণ বেশি গল্প প্রকাশ করি,” জানান তিনি। “অধিকাংশ লেখক তাদের বাড়ি হারিয়েছে, ল্যাপটপ হারিয়েছে, বিদ্যুৎ বা ইন্টারনেট নেই। তারা ফোনে গল্প লেখে, কয়েকদিন অপেক্ষা করে কানেকশন পেলে পাঠায়। প্রতি মাসে ৩৫ থেকে ৪০টি গল্প আমরা প্রকাশ করি।”
“আমরা গাজার ইতিহাস সংরক্ষণ করছি—পরিসংখ্যান দিয়ে নয়, বরং জীবিত মানুষের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। এটা রাজনৈতিক প্রকল্প নয়, এটা মানবিক প্রকল্প।”
লিখেছেন, কিলিয়ান ফক্স
দ্য গার্ডিয়ান, ১৩ এপ্রিল ২০২৫