স্টিভ জবসের ৫৬ বছরের জীবন, যা বদলে দিয়েছে পুরো পৃথিবী - Angan

প্রযুক্তির জগতে বহু নাম এসেছে এবং গিয়েছে, কিন্তু কিছু নাম সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে অনন্ত হয়ে গেছে। স্টিভ জবস এমনই এক নাম। তিনি ছিলেন শুধু একজন উদ্যোক্তা বা উদ্ভাবক নন—তিনি ছিলেন একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি আমাদের চোখে ভবিষ্যতের ছবি এঁকেছিলেন, এবং সেই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলেছেন নিজের হাতে।

আজ আমরা যখন আইফোনে স্ক্রল করি, ম্যাকে কাজ করি, কিংবা আইপ্যাডে সিনেমা দেখি—সেই প্রতিটি মুহূর্তে জবসের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন দেখি। কিন্তু এই মসৃণ গ্লাস আর অ্যালুমিনিয়ামের আড়ালে ছিল এক আগুন জ্বলা মনের গল্প, যা আমাদের শেখায়—যে মানুষ ভিন্নভাবে ভাবে, তার পক্ষেই সম্ভব বিশ্বকে বদলে দেওয়া।

বিদ্রোহী মনের জন্ম
স্টিভ জবসের জন্ম হয় ১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, ক্যালিফোর্নিয়ার সান ফ্রান্সিসকোতে। জন্মের পরপরই তাঁকে দত্তক নেন পল ও ক্লারা জবস, এক সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। ছোটবেলা থেকেই স্টিভ ছিলেন প্রশ্নবিদ্ধ, জটিল চিন্তায় ডুবে থাকা এক কৌতূহলী শিশু। প্রযুক্তির প্রতি তাঁর আকর্ষণ ছিল প্রায় চৌম্বকীয়।

বিদ্যালয়ে খুব একটা নিয়মমাফিক পড়াশোনা করতেন না। কিন্তু গ্যারেজে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ইলেকট্রনিক্স নিয়ে কাটিয়ে দিতেন। সেই সময়েই তাঁর সাথে পরিচয় হয় আরেক প্রতিভাবান, কিন্তু শান্ত প্রকৃতির স্টিভ ওজনিয়াকের সঙ্গে

অ্যাপলের সূচনা: প্রযুক্তি যখন শিল্প হয়ে ওঠে
১৯৭৬ সালে, মাত্র ২১ বছর বয়সে, নিজের গ্যারেজে Apple Computer Inc. প্রতিষ্ঠা করেন জবস এবং ওজনিয়াক। তাদের লক্ষ্য ছিল সাহসী—কম্পিউটারকে ঘরের জিনিসে পরিণত করা। একটি জটিল মেশিনকে সহজ, সুন্দর এবং সবার জন্য ব্যবহারযোগ্য করে তোলা।
Apple I ছিল শুরুর পদক্ষেপ, কিন্তু Apple II দিয়ে শুরু হয় সত্যিকারের বিপ্লব। গ্রাফিকস, রঙ এবং ব্যবহারকারী বান্ধব ডিজাইন—সব কিছু মিলে এটি একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন হয়ে দাঁড়ায়। তরুণ জবস রাতারাতি প্রযুক্তির নায়ক হয়ে ওঠেন।

নিজের প্রতিষ্ঠানে বহিষ্কার
কিন্তু সফলতার পথ সবসময় সরল নয়। অ্যাপলের অভ্যন্তরীণ মতপার্থক্যে ১৯৮৫ সালে মাত্র ৩০ বছর বয়সেই নিজের প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি থেকে বহিষ্কৃত হন জবস। এটা ছিল এক ভয়ানক ধাক্কা।

তবে জবস হাল ছাড়েননি। তিনি বলেছিলেন:

“আমি অ্যাপল থেকে বরখাস্ত হবার পর বুঝতে পারি, আমি যা করি তা আমি ভালোবাসি। এবং সত্যিকারের ভালোবাসা হারায় না।”

নেক্সট ও পিক্সার: দ্বিতীয় অধ্যায়ের সূচনা
অ্যাপল ছাড়ার পর তিনি তৈরি করেন NeXT Inc., একটি হাই-এন্ড কম্পিউটার কোম্পানি, যা ভবিষ্যতের macOS এর ভিত্তি তৈরি করে দেয়। সেই সময়ই তিনি মাত্র ৫ মিলিয়ন ডলারে কিনে নেন Pixar নামক এক অজানা অ্যানিমেশন স্টুডিও।

এখানেই ঘটে আরেক বিপ্লব। Toy Story (1995) ছিল প্রথম পুরোপুরি কম্পিউটার অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র—এবং এককথায় ইতিহাস। এরপর Finding Nemo, The Incredibles, Up—প্রতিটি ছবি প্রযুক্তি ও আবেগের এক দুর্দান্ত সংমিশ্রণ।

প্রত্যাবর্তন
১৯৯৭ সালে, ধুঁকতে থাকা অ্যাপল NeXT কে কিনে নেয়—এবং জবস ফিরে আসেন নিজের মঞ্চে। তারপর একে একে আসে iMac, iPod, iTunes, এবং অবশেষে—iPhone।
২০০৭ সালে, আইফোন শুধু ফোন নয়, এক পুরো জীবনধারা বদলে দেয়। আমরা যেভাবে গান শুনি, ছবি তুলি, ইন্টারনেট ব্যবহার করি—সবকিছু এক নতুন রূপ পায়। এরপর আসে iPad—একটি নতুন ধরণের কম্পিউটিং অভিজ্ঞতা।
স্টিভ জবস Apple-কে পরিণত করেন বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান ব্র্যান্ডে। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা—তিনি প্রযুক্তিকে করে তোলেন ব্যক্তিগত, আবেগময়, এবং নান্দনিক।

মানুষের আড়ালে মানুষ
জবস ছিলেন নিখুঁততার পূজারি। তিনি কঠোর, তীব্র, কিন্তু একই সাথে আবেগপ্রবণ ও দার্শনিক। তাঁর বিখ্যাত “Stevenotes” ছিল আধুনিক যুগের প্রযুক্তি মঞ্চের নাটক।
তিনি একই পোশাক পরতেন প্রতিদিন—কালো টার্টলনেক, জিন্স, আর নিউ ব্যালান্স জুতো। meditator ছিলেন, বৌদ্ধ দর্শনে বিশ্বাস করতেন। জীবন ও মৃত্যুকে দেখতেন এক গভীর দৃষ্টিতে।

উত্তরাধিকার: যা থেকে যাবে চিরকাল
স্টিভ জবস ২০১১ সালের ৫ অক্টোবর, মাত্র ৫৬ বছর বয়সে ক্যান্সারে মৃত্যুবরণ করেন। কিন্তু তার প্রভাব, তার দৃষ্টিভঙ্গি, তার চিন্তাধারা আজও প্রতিটি প্রযুক্তিপণ্যে, প্রতিটি উদ্যোক্তায়, প্রতিটি স্বপ্নদর্শীর হৃদয়ে বেঁচে আছে।

তিনি আমাদের দেখিয়েছেন— প্রযুক্তি শুধু যন্ত্র নয়, শিল্প হতে পারে। ডিজাইন শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্য নয়, অনুভূতির প্রসার। চিন্তায় ভিন্নতা মানে, ভবিষ্যতের দিগন্ত খোঁজা।

“যারা এতটা পাগল যে ভাবে তারা পৃথিবী বদলাতে পারে—সত্যি সত্যিই তারাই সেটা করে দেখায়।” – স্টিভ জবস

আপনি যদি কখনও নিজের স্বপ্ন নিয়ে সন্দিহান হন, নিজের পথ নিয়ে দ্বিধায় থাকেন, মনে রাখবেন—স্টিভ জবসও একসময় সেই গ্যারেজেই শুরু করেছিলেন। আর সেই গ্যারেজ থেকে বেরিয়ে এসেছিল এমন এক দৃষ্টিভঙ্গি, যা বদলে দিয়েছে গোটা দুনিয়াকে।

সুতরাং, নিজের স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরুন। ভাবুন ভিন্নভাবে। এবং বিশ্বকে দেখিয়ে দিন—আপনিও পারেন।