নুসরাত ফতেহ আলি খান: ধ্বনির মাঝে দ্যুতিময় এক আত্মা - Angan

বিশ্ব সংগীতের ইতিহাসে এমন কিছু কণ্ঠ থাকে, যাদের গান শুধু শোনা যায় না—অনুভব করা যায়, হৃদয়ে গেঁথে যায়। এমনই এক কণ্ঠের নাম নুসরাত ফতেহ আলি খান। একজন পাকিস্তানি কাওয়ালি শিল্পী, যিনি শুধুমাত্র সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন না—ছিলেন একাধারে সাধক, পথপ্রদর্শক এবং এক অনন্য সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন। তাঁর গানে ছিল আধ্যাত্মিকতা, প্রেম, উন্মাদনা ও ঈশ্বরানুভূতির অদ্ভুত মিশ্রণ।

এই নিবন্ধে আমরা জানব নুসরাত ফতেহ আলি খানের জীবন, তাঁর সংগীতের যাত্রা, বৈশ্বিক প্রভাব এবং কেন তিনি আজও অমর।

শৈশব ও পারিবারিক সংগীত ঐতিহ্য
নুসরাত ফতেহ আলি খান জন্মগ্রহণ করেন ১৩ অক্টোবর ১৯৪৮ সালে, লাইলপুর (বর্তমান ফয়সালাবাদ), পাকিস্তানে। তিনি জন্মেছিলেন একটি প্রাচীন কাওয়াল পরিবারে, যার সংগীতচর্চার ইতিহাস ছিল ৬০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। তাঁর বাবা উস্তাদ ফতেহ আলি খান ছিলেন বিখ্যাত কাওয়াল এবং শাস্ত্রীয় সংগীতজ্ঞ।

শৈশবে তাঁর উপর কোনো সংগীতচর্চার প্রত্যাশা ছিল না। তাঁর বাবা চেয়েছিলেন তিনি ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হোক। কিন্তু ঈশ্বরের লেখা আলাদা ছিল। ১৯৬৪ সালে তাঁর বাবার মৃত্যুর পর, কিশোর নুসরাতের মধ্যে সংগীতের আগুন জ্বলে ওঠে।

সংগীতের সাধনা ও আত্মপ্রকাশ
নুসরাত তাঁর চাচা উস্তাদ মুবারক আলি খান ও উস্তাদ সালামত আলি খান এর অধীনে কঠোর রেওয়াজ শুরু করেন। তিনি শিখেছিলেন রাগ, তাল, খেয়াল, ধ্রুপদ সহ বহু শাস্ত্রীয় ধারা—যা পরে তাঁর কাওয়ালিতে গভীরতা ও সৌন্দর্য এনে দেয়।
তাঁর প্রথম বড় মঞ্চে পরিবেশনা হয় ১৯৬৫ সালে, একটি সুফি দরগায় বাৎসরিক ওরস উৎসবে। এরপর ১৯৭১ সালে তিনি তাঁর পারিবারিক কাওয়ালি দলের নেতৃত্ব নেন। আর তখন থেকেই শুরু হয় নুসরাতের কণ্ঠের বিস্ময়কর উত্থান।

এক কিংবদন্তির উত্থান
৮০-র দশকে পাকিস্তানে তিনি হয়ে উঠেছিলেন কাওয়ালি সংগীতের অবিসংবাদিত নেতা। তাঁর কণ্ঠ ছিল তীব্র, গভীর, বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং জাগ্রতকারী। তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান গাইতে পারতেন ক্লান্তি ছাড়াই। তাঁর সুর ছিল যেন আত্মার আহ্বান—শুধু গান নয়, একপ্রকার আত্মসমর্পণ।

১৯৮৫ সালে ইংল্যান্ডের WOMAD (World of Music, Arts and Dance) ফেস্টিভ্যালে পারফর্ম করার মাধ্যমে তিনি আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিলেন পিটার গ্যাব্রিয়েল, যিনি পরে তাঁর জন্য Real World Records লেবেল তৈরি করেন।

সীমানার বাইরে: ফিউশন, ফিল্ম ও বিশ্বসংগীতে যাত্রা
নুসরাত শুধু ঐতিহ্যবাহী কাওয়ালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেননি। তিনি ছিলেন এক নিরীক্ষাপ্রবণ শিল্পী। তিনি কানাডিয়ান মিউজিশিয়ান মাইকেল ব্রুক-এর সাথে Mustt Mustt ও Night Song অ্যালবাম করেন, যা ওয়েস্টার্ন শ্রোতাদের মন জয় করে নেয়।

তিনি বলিউডের এ.আর. রহমান, অমিত ত্রিবেদী-দের সঙ্গে কাজ করেছেন, এমনকি তাঁর গান শোনা গেছে Dead Man Walking, Natural Born Killers-এর মতো হলিউড সিনেমাতেও।

সমালোচকরা কখনো কখনো তাঁকে অভিযুক্ত করেছিলেন ‘ধর্মীয় গানকে কমার্শিয়ালাইজ’ করার জন্য। কিন্তু নুসরাত বলেছিলেন—
“আমি কাওয়ালির আত্মাকে নষ্ট করছি না, বরং তাকে বিশ্ব দরবারে পৌঁছে দিচ্ছি।”

সুফি প্রেম ও আধ্যাত্মিকতা
নুসরাতের গানের প্রধান উপজীব্য ছিল প্রেম ও আধ্যাত্মিকতা—যার উৎস ছিল সুফি কবিদের লেখা। তিনি গাইতেন রুমি, বুল্লে শাহ, আমির খসরু, হজরত সুলতান বাহু প্রমুখের কবিতা।
“আল্লাহ হু”, “আফরিন আফরিন”, “ইয়ে জো হাল হ্যায় মেরা”, “দমাদম মস্ত কালন্দর”—এই গানগুলো শুধু সুর নয়, দর্শন বয়ে আনে।

দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত ওজন এবং ডায়াবেটিসজনিত কারণে তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ১৯৯৭ সালের আগস্টে লন্ডনে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় মৃত্যুবরণ করেন মাত্র ৪৮ বছর বয়সে।
তাঁর মৃত্যুতে পাকিস্তানসহ গোটা বিশ্ব সংগীতজগতে শোকের ছায়া নেমে আসে। তবে তাঁর সংগীত আজও জীবন্ত। তাঁর ছাত্র ও ভাগ্নে রহত ফতেহ আলি খান তাঁর উত্তরসূরি হয়ে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।
নুসরাত ফতেহ আলি খান শুধু একজন কাওয়ালি গায়ক ছিলেন না—তিনি ছিলেন এক সাংস্কৃতিক দূত, এক আধ্যাত্মিক শিল্পী, যিনি সুরের মাধ্যমে মানুষের হৃদয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করিয়ে দিতেন।

আজও যখন তাঁর গান বাজে, একটা ঘোর, একটা তীব্র অনুভব সৃষ্টি হয় হৃদয়ের গভীরে। তাঁর কণ্ঠ এখনো বলে—”তুমি আল্লাহকে খুঁজো, প্রেমকে খুঁজো, নিজের আত্মাকে খুঁজো।”