রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ: একটি প্রতিরোধী কণ্ঠস্বর, একটি অমর রোমান্টিকতা
“ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো”
এক পরিচিত নাম, এক অপরিচিত গভীরতা
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ—বাংলা কবিতার সেই কণ্ঠস্বর, যিনি সাহসের সঙ্গে বলেছিলেন, “আমি কিংবদন্তির কথা বলছি।” কিন্তু আজ আমরা কি সত্যিই তাঁকে যথাযথভাবে স্মরণ করি? তাঁর কবিতা শুধু আবেগ নয়, ছিল এক ধরনের আত্মঘাতী সততা, চরম প্রাত্যহিক অভিজ্ঞতার ভাষ্য এবং স্বপ্নভঙ্গের গোপন হাহাকার।
কবিতা তাঁর কাছে শুধু শিল্প ছিল না, ছিল অস্তিত্ব
রুদ্র ছিলেন সেই কবি, যিনি শব্দ দিয়ে শুধু প্রেমের গান লিখেননি, সমাজকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তাঁর কবিতা পড়লেই বোঝা যায়—তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে এগিয়ে থাকা এক মানবিক বুদ্ধিজীবী। তাঁর রচনায় প্রেম যেমন অনিবার্য, তেমনি রাজনীতি, শ্রেণিচেতনা, নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদও তীব্রভাবে স্পষ্ট।
“আয়নার ভিতর মুখ নয়, একটি যুদ্ধ দেখি…”
এই পঙক্তির মধ্যে যে আত্মসমীক্ষা, যে অস্তিত্ববাদী যন্ত্রণার ছাপ—তা বিংশ শতকের বাংলা কবিতায় খুব কম কবির মধ্যেই দেখা যায়।
সাহিত্যের প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডির বাইরে এক কবি
রুদ্রের সাহিত্যচর্চা ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করলেও তিনি বেছে নিয়েছিলেন রাস্তাঘাট, মঞ্চ, লোকসমাজকে। তাঁর লেখা প্রায়শই উপেক্ষিত থেকেছে মূলধারার সাহিত্যে—তবু পাঠকের হৃদয়ে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের মধ্যে, তিনি ছিলেন এবং রয়ে গেছেন বিপ্লবী প্রিয়।
তাঁর কাব্যগ্রন্থ যেমন:
উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯)
ফিরে চাই স্বর্গ (১৯৮২)
মানুষ ও কাঙাল (১৯৮৪)
এগুলো কেবল শব্দের খেলা নয়, সময় ও সমাজের গভীর পাঠ।
প্রেম ও প্রস্থান: রুদ্র-তসলিমা সম্পর্ক
রুদ্রের জীবনের আরেকটি আলোচিত অধ্যায় হলো তাঁর বৈবাহিক সম্পর্ক তসলিমা নাসরিনের সঙ্গে। তাঁরা ছিলেন যুগল বিদ্রোহী। এই সম্পর্ক যতটা ছিল আকর্ষণীয়, ঠিক ততটাই ছিল জটিল।
“তোমাকে পাওয়া না পাওয়ার মাঝখানে জ্বলে উঠেছে নীল রঙের আগুন…”
এই লাইনে শুধু একজন প্রেমিক নয়, একজন বেদনাহত সমাজবীক্ষকের সুর পাওয়া যায়।
গান, যে ছিল আত্মার উত্তরণ
রুদ্র কেবল কবিতায় সীমাবদ্ধ থাকেননি। তাঁর কণ্ঠে ছিল গান, গানেও ছিল বিদ্রোহ। তাঁর সুর, তাঁর গলা—সবকিছু ছিল প্রতিবাদময় এক সঙ্গীত। একা গিটার নিয়ে বা বন্ধুদের সঙ্গে সেলাইবিহীন কাপড়ে গান গেয়ে চলে যেতেন বিভিন্ন ক্যাম্পাসে, রাজনৈতিক মঞ্চে।
“ভালো আছি ভালো থেকো”—শুধু একটি গান নয়, এটি আজ একটি কালজয়ী চেতনা, বিচ্ছিন্নতায় পোড়া মানুষের চিঠি।
সময়ের আগেই শেষ হওয়া একটি অধ্যায়
রুদ্রের মৃত্যু আজও এক রহস্য ও শোকের নাম। মাত্র ৩৪ বছর বয়সে ১৯৯১ সালে তিনি চলে গেলেন। কেউ বলেন, এটি ছিল আত্মহত্যা; কেউ বলেন, অসুস্থতা। কিন্তু এর বাইরে যা সত্য, তা হলো—আমরা হারিয়েছিলাম একটি সময়ের কণ্ঠস্বর। একজন রুদ্র, যিনি হলে আজ বেঁচে থাকতেন—হয়তো বাংলা সাহিত্য আরও একটু প্রাসঙ্গিক, একটু সত্যনিষ্ঠ হতে পারত।
তিনি আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ আমরা আজও নিঃশব্দ
আজকের বাংলাদেশে যখন কথার চেয়ে চুপ থাকা নিরাপদ, প্রতিবাদের চেয়ে আপস অনেক সহজ, তখন রুদ্রের কবিতা আমাদের আবার প্রশ্ন তোলে—তুমি কেন চুপ? তুমি কি ভালোবাসতে জানো? তুমি কি সত্যের জন্য মরতে পারো?
এই জায়গায় দাঁড়িয়েই রুদ্র সময়কে অতিক্রম করেছেন। তাঁর কবিতা এখনো নতুন প্রজন্মের জন্য এক আলোর দীপ্তি।
