আমি সেদিন ‘শেষের কবিতা’ পড়া শুরু করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এসে চুপচাপ একটা বেঞ্চে বসে ছিলাম। পাশেই কফির কাপ, মোবাইলটা সাইলেন্টে। পৃষ্ঠা উল্টে পড়তে পড়তে যখন লাবণ্য আর অমিতের কথোপকথন এলো, একটা মুহূর্তে আমার মনে হলো—“আরে, একটা বাক্য এত দীর্ঘ কেন?” একটা বাক্যই যেন একটা ছোটগল্প! ক্লজের পর ক্লজ, উপমার পর উপমা।
সেদিনের মতো পড়া বন্ধ করে দিলাম। পরে বাসায় ফিরে ইনস্টাগ্রামে ঢুকেই দেখি—“10 Books You Must Read in 2025” রিল ঘুরছে। ১৫ সেকেন্ডে ১০টা বই রিভিউ। চমকপ্রদ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, বড় বড় লেখা, দ্রুত গতির ভিজ্যুয়াল। মনটা সেখানেই আটকে গেল।
এই দুই অভিজ্ঞতার মাঝে ফারাক শুধু মাধ্যমের না, চিন্তারও। একটা ধীরে, গভীর। অন্যটা দ্রুত, চটকদার। প্রশ্নটা উঠলো—রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ বাক্য আমাদের জন্য এখন কি অলসতা, না কি ধ্যান?
দীর্ঘ বাক্য বনাম ছোট মনোযোগ
রবীন্দ্রনাথের লেখায় দীর্ঘ বাক্য শুধু ভাষার খেলা নয়, এটা এক ধরণের মানসিক অভ্যাস। প্রতিটি বাক্য যেন একেকটা হাঁটা পথ। সে পথে আপনি ধীরে ধীরে হাঁটবেন, মাঝে মাঝে দাঁড়াবেন, চারপাশ দেখবেন, নিজের ভিতরের কথাগুলো শুনবেন।
ধরা যাক, “সে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া পাতার মতো ভেসে যাচ্ছিল, কোনো গন্তব্যের দিকে নয়, বরং এক অনির্দিষ্টতার মধ্যে।” — এমন বাক্য পড়লে কি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলা যায়? না, পড়তে হয় ধীরে, একটু থেমে, বারবার। তখনি বোঝা যায়—এখানে কেবল গল্প বলা হচ্ছে না, একটা অভিজ্ঞতা তৈরি হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ আমাদের পাঠের সাথে একটা নিরব সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছেন। তাঁর বাক্য শুধু তথ্য দেয় না, চিন্তার অনুশীলনও শেখায়।
আমরা আজ এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে মনোযোগই সবচেয়ে দুর্লভ সম্পদ। ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউব শর্টস—এসব প্ল্যাটফর্ম আমাদের শেখায় কীভাবে ৮ সেকেন্ডে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। “ভালো লাগছে?”—লাইক। “বোরিং?”—স্ক্রল।
মনোযোগের এই ছেঁড়া ছেঁড়া অভ্যাস আমাদের ভাবনার গভীরতা কমিয়ে দিচ্ছে। বড় বাক্য পড়তে এখন ক্লান্তি লাগে, কারণ আমাদের মস্তিষ্ক এখন অভ্যস্ত ক্ষুদ্র ও দ্রুত খণ্ডে ভাবতে।
একটা সময় ছিল যখন আমরা একটা বই হাতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। এখন? মোবাইল হাতে থাকলে একটা নোটিফিকেশনেই মন বিঘ্নিত। রবীন্দ্রনাথের লেখায় প্রবেশ করতে হলে যা দরকার—সেই মনোযোগ, ধৈর্য, নিঃশব্দতা—তা আজ বিলাসিতা মনে হয়।
আমি নিজে যখন লিখি, তখনও দ্বন্দ্বে ভুগি। পাঠক কি এত বড় বাক্য পড়বে? অনেকে তো প্রথম বাক্যই শেষ না করে ছেড়ে দেয়। “ছোট লেখো, পরিষ্কার লেখো”—এসব পরামর্শ আমাদের লেখালেখির দুনিয়ায় এখন প্রায় বাণী হয়ে উঠেছে।
তবে কখনো কখনো আমি নিজেই লেখার মধ্যে হারিয়ে যাই। যখন একটা বাক্য শুরু করি আর মনে হয়, এই চিন্তাটা এখানে থামানো যাবে না। একটা ভাবনা অন্য ভাবনাকে ডাকে, একটা অনুভব আরেকটিকে জন্ম দেয়। তখন বাক্য নিজেই বড় হয়ে যায়। তখন লেখাটাই হয়ে ওঠে এক ধরণের জার্নি। ঠিক যেমনটা রবীন্দ্রনাথ করতেন।
রবীন্দ্রনাথের বাক্যের ভেতর দিয়ে চিন্তার অনুশীলন
রবীন্দ্রনাথের লেখায় যে লম্বা বাক্য, তা কিন্তু আত্মপ্রকাশের এক ধরণের দায়বদ্ধতা। চিন্তার সম্পূর্ণ রূপ প্রকাশের জন্য অনেক সময়ে ছোট বাক্য যথেষ্ট নয়। যেমন প্রেম, যেমন বেদনা, যেমন সংকট—সবকিছুরই বহুস্তর থাকে।
যদি আমরা শুধু টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে অভ্যস্ত হই, তাহলে দীর্ঘ বাক্যই হারিয়ে যাবে না, হারাবে একটি ধরণের অনুভব, অনুভবের গভীরতা। চিন্তা করার ক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে পড়বে। সাহিত্য হবে কোটেশনের উৎস, সংবেদনশীলতার নয়।
কিন্তু সাহিত্যের আসল কাজ তো আমাদের ভিতরকার অদেখা অংশগুলোকে দেখা, না?
রবীন্দ্রনাথ লিখতেন মন্থর ভাষায়, কারণ মন্থরতা নিজেই ছিল একটি অবস্থান—বিশ্বকে বোঝার, গ্রহণ করার, এবং ভালোবাসার। আমরা যদি কেবল দ্রুততার জগতে বাঁচি, তবে হয়তো আমরা সাহিত্য নয়, শুধুই ‘কনটেন্ট’ পাব।
এই প্রশ্ন অনেকেই করেন। রবীন্দ্রনাথ কি এখনকার তরুণদের জন্য প্রাসঙ্গিক? তাঁর ভাষা কি এতটাই “পুরনো” যে তা এখন আর টানে না?
আমি বলবো—রবীন্দ্রনাথ এখনো আছেন, শুধু তাঁকে পাওয়ার জন্য আমাদের ভেতরের ছন্দ বদলাতে হবে। আমরা যদি ধৈর্য ধরি, শব্দের গভীরে নামি, তবে দেখব—তিনি এখনো কথা বলেন।
আমার এক বন্ধু বলেছিল—“রবীন্দ্রনাথ পড়তে পড়তে আমি আমার ভেতরকার চিন্তাগুলোকে চিনতে শিখেছি। আগে যেগুলো ছিল এলোমেলো, তিনি সেগুলোকে ভাষা দিয়েছেন।”
রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে অনুভব করতে হয়। তিনি আমাদের চেতনার ভাষা। সেই ভাষা দ্রুত না হলেও সত্য। সে ভাষা এখনো আমাদের দরকার।
রবীন্দ্রনাথকে পড়ার মানে এই নয় যে আপনাকে একসাথে গীতাঞ্জলি পড়ে শেষ করতে হবে। আপনি শুরু করতে পারেন—একটা কবিতা দিয়ে, একটা চিঠি দিয়ে (যেমন ছিন্নপত্র), একটা গান দিয়ে, আর তারপর তার পেছনের ভাবনাটা খুঁজে দেখে। পড়ার অভ্যাসটা ধীরে ধীরে গড়ে তুলুন। আপনি যখন মোবাইল বন্ধ করে দশ মিনিট শুধু একটা প্যারা পড়েন, তখনই একটা নীরবতা তৈরি হয়। সেই নীরবতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আসেন।
তিনি আমাদের শেখান—থেমে পড়তে, দেখার আগেই না বুঝে ফেলতে, অনুভবের ভাষা খুঁজে পেতে। টিকটকের যুগে সেই শিক্ষা হয়তো দুর্লভ, কিন্তু অমূল্য।
রবীন্দ্রনাথকে পড়া মানে বড় কিছু বোঝা নয়—বরং নিজের ভিতরের সেই অংশটুকু ছুঁয়ে ফেলা, যা প্রতিদিনের স্ক্রলিংয়ে হারিয়ে যায়।
যদি আমরা সেই অংশটুকুকে আবার জাগাতে চাই, তাহলে আমাদের আবার পড়তে হবে—ধীরে, দীর্ঘভাবে, রবীন্দ্রনাথের মতো করে।