আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, বাংলার প্রখর রৌদ্রে জ্বলে উঠেছে এক চেতনার দীপ্তিময় শিখা। আজ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন—একশো ছাব্বিশ বছর আগে এই দিনে চুরুলিয়ার আকাশে এক বিদ্রোহী নক্ষত্রের উদয় হয়েছিল, যার আলো আজও নিভেনি, নিভবেও না।
তিনি ছিলেন কেবল কবি নন—তিনি ছিলেন এক রণধ্বনি, এক স্বপ্ন, এক দুর্বার আকাঙ্ক্ষার নাম। কখনো আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠেছেন, আবার কখনো নদীর মতো শান্ত স্রোতে গান বেঁধেছেন প্রেমের, ভালোবাসার, মানবতার। নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী, কিন্তু সেই বিদ্রোহে ছিল ভালোবাসা, ছিল করুণা, ছিল গভীর এক মুক্তির স্বপ্ন।
যে সময়ে বাংলার হৃদয়ে দাসত্বের শৃঙ্খল, মৌলবাদ আর বৈষম্যের বিষবাষ্প জমে উঠেছিল—সেই সময়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, “আমি বিদ্রোহী, আমি বিশ্ববিধাতার কাছে করিয়াছি প্রতিবাদ!” এই প্রতিবাদ ছিল মানুষের পক্ষে, শোষিতের পক্ষে, এবং সত্য ও সৌন্দর্যের পক্ষে।
কিন্তু নজরুল মানেই কেবল জাগরণের কবি নন। তিনি প্রেমের কবিও বটে—যে প্রেমে নেই কৃত্রিমতা, নেই বাধা। যে প্রেম অচেনা পথিকের চোখে খুঁজে নেয় আপনজনকে।
তার কলমে প্রেম যখন উচ্চারিত হয়, তখন শব্দগুলো হয়ে ওঠে শরতের আকাশে উড়তে থাকা কাশফুলের মতো—
“চাঁদ যদি রাত্রির চোখে স্বপ্ন হয়ে নামে,
তবে তুই আমার ভালোবাসা—জীবনের চিরপ্রেমে।”
নজরুলের লেখায় বারবার ফিরে এসেছে সমতা ও সাম্যের বার্তা। তিনি যখন বলেন—“মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান,” তখন তা শুধু পঙ্ক্তি নয়, হয়ে ওঠে ইতিহাসের এক স্পষ্ট দৃষ্টিকোণ। তাঁর সাহিত্য আজও ধর্মান্ধতার মুখে তির হয়ে বাজে, বিভেদের প্রাচীরে ধাক্কা দিয়ে বলে—ভালোবাসো, ভালোবাসো নিঃস্ব, শোষিত, পথহারা মানুষকে।
তাঁর গান ছিল গানের চেয়েও বেশি কিছু। নজরুল-সঙ্গীত বাংলা মাটির হৃদয়। তাঁর সুরে ছিল আগুন, তাঁর ছন্দে ছিল ঝড়, তাঁর গলায় ছিল এক উদাত্ত আহ্বান—“চল্ চল্ চল্”—যা প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিটি প্রতিবাদে, প্রতিটি নবযাত্রায়।
শুধু যুদ্ধের গান নয়, শ্যামা-সঙ্গীত, ইসলামি সংগীত, রাগাশ্রিত গান—সবখানেই তিনি রেখে গেছেন তাঁর বিস্ময়কর সুরের স্বাক্ষর। ধর্ম ছিল তাঁর হৃদয়ের স্তব, কিন্তু বিভেদের দেয়াল ভাঙাই ছিল তাঁর সাধনা।
দীর্ঘ নীরবতার অসুখ তাকে বাকরুদ্ধ করলেও, তার সৃষ্টি থেকে কোনোদিন থেমে যায়নি চেতনাধ্বনি। তিনি নিঃশব্দ থেকেও উচ্চারণ করেন আজও, “আমি কণ্ঠহারা, তবু কণ্ঠস্বরে বাঁচি।”
স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীতে যখন তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, তখন তা ছিল শুধু কবিকে নয়, বাংলার প্রাণকে শ্রদ্ধা জানানো। তাঁর লেখা আজও পাঠ্য, প্রার্থ্য, প্রেরণা।
নজরুল বেঁচে আছেন আমাদের প্রতিটি প্রতিবাদে, প্রতিটি ভালোবাসায়, প্রতিটি সাম্যের আকাঙ্ক্ষায়। নজরুল আছেন গ্রামীণ কোনো মঞ্চে মুখস্ত বলা কবিতায়, আবার আছেন নগরীর কোনো ব্যানারে, দেয়ালে, বুকের ভেতরে।
তাঁর জন্মদিনে তাকে ফুল দিয়ে নয়, কণ্ঠে তুলে নিই তারই উচ্চারণ—
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”
আজকের দিনটিতে, আমরা যদি সত্যিই নজরুলকে ভালোবাসি, তবে তার মতো করে ভালোবাসতে শিখি মানুষকে, সংগ্রামকে, শিল্পকে।
কারণ নজরুল কেবল কবি ছিলেন না, নজরুল ছিলেন বাংলা নামক আত্মার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নজরুলের চেতনাকে বিনম্র শ্রদ্ধা, আগুনছোঁয়া ভালোবাসা।