Friedrich Nietzsche

আধুনিক সময়ের প্রতিবাদের ভাষা বদলে গেছে। ব্যানারগুলোতে এখন শুধু “ন্যায়বিচার চাই” লেখা থাকে না — লেখা থাকে “ন্যায়বিচার না পেলে শান্তি নয়”, “আমরাই ৯৯%”, “প্যালেস্টাইন মুক্ত হোক”, “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার”, “পৃথিবীকে বাঁচাও”, “সীমানা নয়, সহাবস্থান চাই”। এই আন্দোলনগুলো যৌথ, এই দাবিগুলো বৈশ্বিক। কিন্তু প্রতিটি স্লোগানের মাঝখানে, প্রতিটি জমায়েতের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকে একজন করে মানুষ — একক, দোদুল্যমান, কল্পনাপ্রবণ, সোশ্যাল মিডিয়াতে স্ক্রল করতে করতে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে চলা।

এইখানেই কি নিটশেকে ডাকা যায়?
ফ্রিডরিখ নিটশে — উনিশ শতকের জার্মান দার্শনিক, যিনি বলেছিলেন “ঈশ্বর মৃত”, যাঁর লেখার ভঙ্গি ছিল কবিত্বময়, যিনি ‘উবারমেনশ’ বা অতিমানবের কথা বলেছিলেন — তিনি কি আদৌ আজকের যুগের প্রতিবাদীদের জন্য প্রাসঙ্গিক? একজন লেখক যিনি ‘হিসাবি নৈতিকতা’-কে বিশ্বাস করতেন না, যিনি ‘হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া’ জনমতকেও সন্দেহের চোখে দেখতেন, তিনি কি ‘ভালো মানুষের আন্দোলনের’ পাশে থাকতে পারেন?

হয়তো ঠিক সেই কারণেই তাঁকে আবার পড়া দরকার।
কারণ নিটশে আমাদের শেখান, নিজেকে খুঁজে পাওয়া একটি কাজ — একটি ‘অ্যাক্ট’। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজ আমাদের তৈরি করে তোলে। সমাজ আমাদের বলে দেয় আমরা কে, কীভাবে ভাববো, কী ভালো, কী মন্দ। কিন্তু ব্যক্তিসত্তার জন্ম হয় তখনই, যখন আমরা এই সব ধারণার মুখোমুখি হই — এবং প্রশ্ন তুলি।

হ্যাশট্যাগ যুগে প্রশ্নের ভাষা
আজকের যুগে, যখন আন্দোলনের ভাষা ফেসবুক পোস্ট আর ইনস্টাগ্রাম রিলে সীমাবদ্ধ, যখন আমরা একটি হ্যাশট্যাগে মিলিয়ে ফেলার চেষ্টা করি আমাদের পুরো অস্তিত্ব, নিটশে বলেন — দাঁড়াও। তুমি কীভাবে জানো তুমি যা ভাবছো তা সত্যিই তোমার নিজের ভাবনা? তুমি কী নিজেকে গড়ছো, না কি শুধুই অনুকরণ করছো?

এইখানেই নিটশের ‘ইচ্ছাশক্তির দর্শন’ বা ‘will to power’-এর কথা আসে। তিনি বলতেন, এটি অন্যদের উপর ক্ষমতা বিস্তারের কথা নয় — এটি নিজের ভেতরের সেই সত্তাকে তৈরির কথা, যে নিজস্ব নৈতিকতা, নিজস্ব মূল্যবোধ নিয়ে সামনে এগোয়।

নতুন প্রজন্মের অনেকেই আজ প্রতিবাদ করছে — জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে জাতিগত বৈষম্য, লিঙ্গ রাজনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষার সুযোগ — তারা সাহসী, তারা সোচ্চার। কিন্তু অনেক সময় সেই প্রতিবাদের ভেতরে তাদের নিজের সত্তা হারিয়ে যায়। তারা কখনো একটি দলের অংশ হয়ে যায়, কখনো একটি আদর্শের ছায়ায় ঢেকে যায়।

নিটশে আমাদের বলেন, প্রশ্ন করো। নিজের দলকে, নিজের বিশ্বাসকে, এমনকি নিজের ‘ভালো’ হবার চেষ্টাকেও প্রশ্ন করো। প্রশ্ন করো — আমি কি সত্যিই নিজেকে গড়ে তুলছি, না কি শুধু অনুসরণ করছি?

নতুন প্রতিবাদ, পুরনো আত্ম-অনুসন্ধান
তাঁর চোখে, আসল প্রতিবাদ হলো নিজের ভিতরের স্ববিরোধিতা, দ্বিধা, সংশয় — এসবকে আলিঙ্গন করা। আসল সংগ্রাম হলো নিজের ভেতরে থাকা স্বরকে জাগিয়ে তোলা, এমনকি তা যদি জনপ্রিয়তার বিরুদ্ধে যায়।

আজকের নতুন প্রতিবাদকারীরা যদি নিটশেকে পড়েন, তাঁরা হয়তো একটা নতুন ধরনের প্রশ্ন করতে শিখবেন — কেবল “এই অবিচার কেন?” নয়, বরং “আমার অবস্থান কী?”, “আমার মূল্যবোধ কি নিজস্ব?”, “আমি যা বলছি, তা সত্যিই বিশ্বাস করি তো?”

নিটশে কখনোই আমাদের বলেননি কী ভাবতে হবে, বরং কেমন করে ভাবা উচিত — সে কৌশল তিনি শেখাতে চেয়েছেন। তাঁর কাছে আত্ম-অনুসন্ধান মানে ছিলো এক ধরনের বিপ্লব। এই বিপ্লব বাহ্যিক নয়, এটি চেতনার ভিতর ঘটে। এইখানে কোনো মিছিল নেই, কিন্তু আছে একাকী রাতের নিঃশব্দ প্রশ্ন, নিজের ভুল মেনে নেওয়ার সাহস, এবং জনপ্রিয় মতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দৃঢ়তা।
সামষ্টিকতার জোয়ারে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতিটি স্লোগান আর ব্যানার একত্রিত করে তোলে মানুষকে, নিটশে আবার মনে করিয়ে দেন — ‘তুমি কে?’ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই আসল বিপ্লব।
এবং সেই উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই, আমাদের নতুন প্রজন্ম একদিন বুঝবে — নিটশে ছিলেন শুধুই দার্শনিক নন, তিনি ছিলেন আত্ম-আবিষ্কারের সবচেয়ে দুর্দান্ত চ্যালেঞ্জ।

Related

দর্শনের পথিক অথচ ইতিহাসে অনুপস্থিত: বাংলার বিস্মৃত দার্শনিকরা | Angan

দর্শনের পথিক অথচ ইতিহাসে অনুপস্থিত: বাংলার বিস্মৃত দার্শনিকরা

বাংলার দর্শনের ইতিহাস মানেই যেন কয়েকটি পরিচিত নাম—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা পাশ্চাত্যের

Read More »
Scroll to Top