বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কি বদলাচ্ছে? ২০২৫-এর পাঠ-চিত্র | Angan

বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কি বদলাচ্ছে? রবীন্দ্রনাথের আমলে ‘পাঠক’ শব্দটি ছিল কিছুটা বিশিষ্ট ও মর্যাদাপূর্ণ। সে এক ধৈর্যশীল, মনোযোগী শ্রোতা, যার চোখে বই ছিল শুধুই জ্ঞান নয়—একটি অভিজ্ঞতা, আত্মদর্শনের আয়না। কিন্তু সময়ের নদী বহু বাঁক পেরিয়ে এসেছে। একবিংশ শতকের প্রথম প্রান্তেই বইয়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটি একটি জটিল, বহুস্তরীয় রূপ নিয়েছে। ২০২৫ সালে এসে ‘নতুন বাঙালি পাঠক’ ঠিক কেমন? তারা কী পড়ে, কেন পড়ে, কোথায় পড়ে?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করি একটি বিচিত্র পাঠাভ্যাসের ভূগোল, যা প্রযুক্তি, সামাজিক পরিবর্তন এবং ব্যক্তিগত অভিরুচির এক সম্মিলন।

পাঠের নতুন ভুবন

২০২৫ সালের বাংলাদেশে পাঠ শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়। স্মার্টফোনের স্ক্রল, ট্যাবের ই-বুক, ইনস্টাগ্রামের ক্যারোসেল পোস্ট, ইউটিউবের সাবটাইটেল, এমনকি পডকাস্টে শোনা সাহিত্যের টুকরো—এসবই এখন “পাঠ”। পাঠকেরা এখন ‘রিডিং’ এবং ‘কনজাম্পশন’-এর ভিন্নধর্মী মেলবন্ধনে বিশ্বাসী। তারা দ্রুত পড়ে, নির্বাচন করে পড়ে, আবার কখনো দীর্ঘদিন ধরে একটি বিষয় নিয়ে পড়ে। এমনকি কেউ কেউ পড়ার চেয়ে “শোনার” মধ্যেই পাঠের আরাম খুঁজে পায়।

এই প্রজন্ম একদিকে যেমন মোবাইল অ্যাপস বা কাইন্ডলের মাধ্যমে ইংরেজি অনুবাদে দস্তয়েভস্কি বা মারকেজ পড়ছে, অন্যদিকে ফেসবুকে “আনপোস্টেড বাংলা কবিতা” বা সাবরিনা বৃষ্টির মতো তরুণ লেখকদের রিল-ভিত্তিক গদ্যে আকৃষ্ট হচ্ছে। পাঠের এই পরিবর্তন শুধু মাধ্যমের নয়, মনোভঙ্গিরও।

সাহিত্য বনাম ইনফোটেইনমেন্ট

বই পড়া মানেই যে সাহিত্য পড়া, এই ধারণা আজ আর স্থির নয়। নতুন পাঠক গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি আত্মজীবনী, ফ্যাক্টচেক ভিত্তিক ইতিহাস, ব্যক্তিগত উন্নয়নমূলক লেখা, এমনকি গভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণেও আগ্রহী। “সাহিত্য” এখন অনেকটাই জায়গা ছাড়ছে “ইনফোটেইনমেন্ট” বা তথ্য+বিনোদনের মিশ্রণকে।

একটি সময় ছিল যখন “কোন বই পড়ছো?” প্রশ্নটি আসত মানসিক বা শৈল্পিক উন্নয়নের লক্ষ্যে। এখন “পড়ছো কেন?” প্রশ্নের জবাবে পাওয়া যায়— “ক্যারিয়ারের জন্য,” “মানসিক হেলথের জন্য,” “ব্রেকআপ সামলাতে,” অথবা “নিজেকে বোঝার জন্য।” অর্থাৎ পাঠকের উদ্দেশ্য অনেক বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আত্মসম্মান-নির্ভর।

পাঠকের বয়স ও শ্রেণি চিত্র

নতুন পাঠকদের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ১৫-৩৫ বছরের তরুণ-তরুণীরা। শহর ও গ্রামীণ এলাকায় তাদের পাঠাভ্যাসে ভিন্নতা থাকলেও মোবাইল ফোনের কারণে এই ব্যবধানও অনেক কমে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইয়ের রিভিউ, লেখকের লাইভ অনুষ্ঠান, ইউটিউব বুক রিভিউ চ্যানেল, কিংবা “বই নিয়ে আড্ডা”—এইসব প্ল্যাটফর্ম পাঠকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করছে।

স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যেমন ‘Rokomari’-তে অর্ডার করে হুমায়ূন আহমেদের বই বা ‘Baatighar’-এর নতুন সাহিত্য সিরিজ সংগ্রহ করছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা “নন-ফিকশন” জগতের দিকে ঝুঁকছে। নারীদের মধ্যে আত্মজীবনী, সাইকোলজি, এবং নারীবাদভিত্তিক সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

পাঠাভ্যাসে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব

একজন পাঠক আজকাল যেভাবে বই পড়েন, তার পেছনে অনেকখানি অবদান সোশ্যাল মিডিয়ার। ইনস্টাগ্রামের ‘বুকস্টাগ্রামার’ কালচার, ফেসবুকের বই রিভিউ গ্রুপ, কিংবা টিকটকের “BookTok” আন্দোলন—সব কিছু মিলিয়ে পাঠ এখন শুধু একান্ত একাকী সাধনা নয়, একটি সামাজিক অংশগ্রহণ।
এমনকি অনেকেই বই কেনেন একটি সুন্দর কভারের জন্য বা একটি লাইনের জন্য, যা তারা শেয়ার করতে পারেন নিজের টাইমলাইনে। ফলে প্রকাশকরা এখন বইয়ের বিষয়বস্তু যেমন ভাবেন, তেমনি ভাবেন ডিজাইন, টাইটেল, এমনকি “ইনস্টাগ্রাম-ফ্রেন্ডলি” কভার নিয়েও।

নতুন লেখক, নতুন পাঠক

২০২৫ সালে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যারা পড়ছে, তারাই লিখছে। একদিকে যেমন পুরনো লেখকেরা নিজেকে নতুন করে উপস্থাপন করছেন (যেমন: সেলিনা হোসেনের ফেসবুক লেখা), অন্যদিকে তরুণ লেখকেরা সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়ায় গদ্য, কবিতা বা চিন্তা প্রকাশ করছেন এবং সেখান থেকেই পাঠক তৈরি হচ্ছে।

স্ব-প্রকাশনার সুযোগ, অনলাইন বুকস্টোর, কিংবা ই-বুক মার্কেটপ্লেসের ফলে লেখক হওয়াটা এখন অনেক বেশি সহজসাধ্য, এবং পাঠকরা নতুন লেখকদের প্রতি অনেক বেশি কৌতূহলী। এই দিক থেকে ‘দাগহীন’, ‘গল্পকার’, কিংবা ‘জিরো ডিগ্রি পাবলিকেশন’-এর মতো ছোট ছোট উদ্যোগগুলো উল্লেখযোগ্য।

বইমেলা ও বিক্রয় ধারা

একসময় বইমেলাই ছিল পাঠকের স্বর্গ। এখন তা আরও বৃহৎ, আরও বাণিজ্যিক, কিন্তু একইসঙ্গে আরও জনপ্রিয়। পাঠকরা বইমেলায় আসছেন শুধু বই কিনতে নয়, লেখককে দেখতে, ছবি তুলতে, লাইভ করতে, কিংবা অটোগ্রাফ নিতে। বই মেলা এখন একটি “ইভেন্ট”—যার ভিতরে বই আছে, বাইরেও অনেক কিছু।

অনলাইন বিক্রয়ের প্রভাবে সারাবছর বই কেনার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। রকমারি, বইপোকা, বইঘর, কাব্যবিন্যাসের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলি শহর ছাড়িয়ে মফস্বলে পৌঁছে যাচ্ছে।

পাঠের মানসিকতা ও ভবিষ্যৎ

নতুন পাঠক বইয়ের মধ্য দিয়ে বাস্তবতা থেকে পালাতে চায় না, বরং বাস্তবতাকে বুঝতে চায়। তারা একটি বই পড়ে প্রশ্ন তোলে, সমালোচনা করে, নিজের জীবনের সঙ্গে মিল খোঁজে। এই পাঠক আরও সংবেদনশীল, আরও সচেতন।

তবে তারা খুব বেশি ধৈর্যশীল নয়। ক্লাসিক বই পড়তে গিয়ে বিরক্ত হয়ে পড়ে, আবার ছোটগল্প বা গ্রাফিক নভেল তাদের কাছে আরও মনোগ্রাহী। ফলে প্রকাশকদেরও ভাবতে হচ্ছে, কীভাবে পাঠকের সময় ও রুচিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখা বা প্রকাশনা করা যায়।

নতুন বাঙালি পাঠক একাধারে বিস্ময়কর এবং আশাব্যঞ্জক। তিনি হয়তো রবীন্দ্রনাথের মত দীর্ঘ কবিতা পড়ে না, কিন্তু তার মনোজগত, কৌতূহল, আত্ম-অন্বেষণ ও জিজ্ঞাসা প্রবল। তিনি বইয়ের পাতা না উল্টালেও স্ক্রিনে পাঠ খুঁজে পান, লেখকের সঙ্গে কথা বলেন, এবং কখনো নিজেই লেখক হয়ে ওঠেন।

২০২৫ সালে এসে বাঙালির পাঠাভ্যাস কোনো একটি ঘরানায় আটকে নেই। বরং তা এক বহুবর্ণিল, চলমান, পরীক্ষণধর্মী একটি অভিজ্ঞতা। বই, পৃষ্ঠা, পডকাস্ট, পোস্ট, ভিডিও—সব মিলিয়ে ‘পাঠ’ এখন আর কেবল নীরব নিভৃত এক সাধনা নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক যাত্রা।

Related

দর্শনের পথিক অথচ ইতিহাসে অনুপস্থিত: বাংলার বিস্মৃত দার্শনিকরা | Angan

দর্শনের পথিক অথচ ইতিহাসে অনুপস্থিত: বাংলার বিস্মৃত দার্শনিকরা

বাংলার দর্শনের ইতিহাস মানেই যেন কয়েকটি পরিচিত নাম—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা পাশ্চাত্যের

Read More »
Scroll to Top