দর্শনের পথিক অথচ ইতিহাসে অনুপস্থিত: বাংলার বিস্মৃত দার্শনিকরা | Angan

বাংলার দর্শনের ইতিহাস মানেই যেন কয়েকটি পরিচিত নাম—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা পাশ্চাত্যের নামজাদা দার্শনিকদের ছায়া। কিন্তু এর বাইরেও ছিল এক বিস্মৃত চিন্তার জগৎ, যেখানে কিছু দার্শনিক, সাধক ও আত্মান্বেষী ব্যক্তিত্ব তাঁদের নিজস্ব পথ খুঁজে নিয়েছিলেন। তাঁদের কেউ হয়তো কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি, কেউ গান বেঁধেছেন আত্মার ভাষায়, কেউবা নিভৃত গ্রামের মাটির ঘরে শিষ্যদের সামনে আত্মজিজ্ঞাসার অনুশীলন করেছেন। মূলধারার আলোচনার বাইরেই থেকে গেছেন তাঁরা, অথচ তাঁদের জীবন ও ভাবনা—উপেক্ষিত হলেও অসাধারণ। আজকের আলোচনায় সেই আড়ালে থাকা পথিকদের কথাই বলা হবে, যাঁরা বাংলার নিজস্ব দর্শনকে নিঃশব্দে বহন করে চলেছেন যুগের পর যুগ।

এইসব নামহীন বা বিস্মৃত প্রান্তিক দার্শনিকরা—তাঁদের নিয়ে কথা বলার সময় এখন। যখন চিন্তা আর অনুভবকে রিল ভিডিওতে গুছিয়ে দেওয়া হয়, তখন এই মানুষদের কথা নতুন করে ভাবার সময়। এখনকার যুগে প্রশ্নের চেয়ে উত্তরের দাম বেশি, কিন্তু এঁরা ছিলেন এমন চিন্তাবিদ, যাঁরা প্রশ্নকে শ্রদ্ধা করতেন, কারণ প্রশ্নই নতুন চিন্তার জন্ম দেয়।

বাংলার ভেতরে ভেতরে দর্শনের একটি মাটি ছিল, যেটি বইয়ের পাতায় নয়, মানুষের হৃদয়ে, আচার-আচরণে, গান-গল্পে রচিত হয়েছে। আজ আমরা সেই শেকড়কে ভুলে যাচ্ছি। কিন্তু একবার যদি শোনো লালন ফকিরের প্রশ্ন—“পাগল মন কি কথা বোলে?”—তবে বুঝবে, সেখানে কত বড় দার্শনিকতা লুকিয়ে আছে। তার মধ্যে আছে অস্তিত্বের প্রশ্ন, আছে আত্মচেতনার খোঁজ, আছে বিশ্বাস আর সন্দেহের দ্বন্দ্ব।

লালন ছিলেন এমন এক চিন্তক যিনি জাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ের খাঁচা ভেঙে দিয়েছিলেন। তাঁর গান ছিল আত্মার মুক্তির গান। লালনের চিন্তা ছিল একধরনের জাগতিক সুফিবাদের প্রতিফলন, যেখানে তিনি মানবতাকেই ধর্ম বলে মেনেছেন। তার চিন্তার মধ্যেই ছিল দার্শনিক প্রতিস্পর্ধা—যেখানে একদিকে সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে আত্মানুসন্ধানের এক গভীর পথ উন্মোচিত হয়েছে।

ঠিক তেমনি শাহ সুফি সাইদুল্লাহ, ফরিদপুরের সুফি আহমদ উল্লাহ, কিংবা ঢাকার অলিগলির মাওলানা শামসুজ্জামান—তাঁদের চিন্তা ছিল অভ্যন্তরের আত্মাকে জানার চেষ্টা। এঁরা সকলেই দর্শনের পথে হাঁটতেন, যদিও তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে বসে প্রবন্ধ লেখেননি। তাঁরা রাস্তায়, খানকায়, বা খেজুর পাতার ছাউনির নিচে বসে দর্শনের চর্চা করেছেন। চিন্তা ছিল তাঁদের জীবনের অংশ, তাঁরা কখনো সেটা আলাদা করে লেখেননি। তাই এঁদের সম্পর্কে জানাও কঠিন, কারণ তাঁরা পাণ্ডুলিপি রেখে যাননি, রেখে গেছেন কথার রেশ, আচার আর প্রভাব।

আমাদের পাঠ্যবইয়ে স্থান না পেলেও, বাংলার বহু মুসলিম দর্শনচর্চাকারী ছিলেন, যাঁদের চিন্তা সময়কে অতিক্রম করেছে। যেমন, গাওসুল আজম দরবেশ তাঁর অনুসারীদের শিক্ষা দিয়েছিলেন “নফস”-এর বিপরীতে “রুহ” কীভাবে বিকশিত হয়। তিনি বলতেন, আত্মাকে জানা মানে সৃষ্টিকে জানা। তাঁর মতে, মানুষই সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা, আর এই মানুষকে বোঝার মাধ্যমেই দর্শনের দরজা খুলে যায়। আবার আবুল কালাম শামসুজ্জামান শিশুদের শেখাতেন প্রশ্ন করা যেন হয় ঈমানের অংশ। এই ছোট ছোট বীজ রোপণ করেছিলেন যারা, তাঁরা দর্শনের কৃষক।

তাঁদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, সাধনা—সবই ছিল দর্শনের নিরব অথচ দৃঢ় বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা জোর করে কোনো ভাবনা চাপিয়ে দেননি, বরং শিষ্যদের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। সুফি চিন্তার মূল ভিত্তিই ছিল এই—অভ্যন্তরীণ অনুভব ও জিজ্ঞাসার মধ্যে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক খোঁজা। আর এই খোঁজটাই ছিল একধরনের পরমত সহিষ্ণুতা, যেখানে নিজস্ব ভাবনাকে অন্যের ভাবনার সঙ্গে শান্তভাবে বসতে দেওয়া হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ, এমনকি ত্রিপুরা-অসম অঞ্চলেও ছড়িয়ে আছেন এই চিন্তকেরা। কেউ গান গেয়েছেন, কেউ সাধনা করেছেন, কেউবা নিরবে আত্মজিজ্ঞাসার চর্চা করেছেন। তাঁদের কেউ আজ মৃত, কেউ আজও জীবিত কিন্তু বিস্মৃত। এই বিস্মৃতির কারণ বহুবিধ—রাজনীতি, ধর্মীয় মেরুকরণ, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সংকীর্ণতা, কিংবা গণমাধ্যমের অমনোযোগ। ফলত, এই দর্শনের ধারাগুলো আজ লোকজ স্মৃতির স্তরে এসে আটকে গেছে।

তাঁদের কেউ লিপিবদ্ধ হননি ইতিহাসে, কিন্তু তাঁদের দর্শন ছড়িয়ে আছে লোকজ স্মৃতিতে। কেউ কেউ হয়তো লিপিবদ্ধও হয়েছেন, কিন্তু পাঠকের অগোচরে হারিয়ে গেছেন। যেমন ধরো মাওলানা আকরাম খাঁ, যিনি সাংবাদিকতার আড়ালে ইসলামি যুক্তিবাদী চিন্তা করতেন। কিংবা ড. আব্দুর রাজ্জাক—যাঁর চিন্তা ছিল আধুনিকতা বনাম ধর্মের জটিল সম্পর্ক নিয়ে। তিনি আমাদের শিক্ষা দেন কিভাবে পশ্চিমা রাজনৈতিক দর্শন ও ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বকে একসঙ্গে বিশ্লেষণ করা যায়। তাঁর শিক্ষার্থীরা বলেন, তিনি ক্লাসে বলতেন, “দর্শন হচ্ছে এমন একটি জায়গা, যেখানে সব যুক্তি, সব প্রশ্ন, সব সংশয় বসতে পারে।”

কিছু বিস্মৃত বাঙালি দার্শনিক :

  • সুফি শাহ আহমদ উল্লাহ (ফরিদপুর)
  • গাওসুল আজম দরবেশ (রংপুর)
  • মাওলানা আবুল কালাম শামসুজ্জামান (ঢাকা)
  • আল্লামা গালিব শাহ (খুলনা)
  • সাধক ধনঞ্জয় দাস বাউল
  • হালিম কুমার পাল (রাজশাহী অঞ্চলে মৌখিক দর্শনচর্চা)
  • রামঠাকুর (ত্রিপুরা)
  • লালন ফকির
  • কমরেড গঙ্গাচরণ দাশ (রাজনৈতিক দর্শনের ধারক)
  • আল্লামা ইসমাইল হক
  • ড. আব্দুর রাজ্জাক
  • মাওলানা আকরাম খাঁ


এই নামগুলো আমাদের শেখায় যে দর্শন কেবল বড় বড় বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সে বেঁচে থাকে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন, প্রশ্ন, বিশ্বাস ও প্রেমে। আমরা যখন আজকের টিকটকের যুগে দাঁড়িয়ে ভাবি যে “দীর্ঘ বাক্য কি টিকে থাকবে?”—তখন এই বিস্মৃত দর্শনচর্চাকারীরা আমাদের কানে ফিসফিস করে বলেন, “চিন্তা সময় চায়, আর সময়ই দর্শনের জন্মদাতা।”
এইসব মানুষদের স্মরণ করাটা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দায়। যাঁদের নাম আমরা জানি না, অথচ তাঁদের চিন্তাই আমাদের অন্তঃশক্তিকে তৈরি করেছে, তাঁদের গল্পগুলো আমাদের জানা উচিত। কারণ যে জাতি তার চিন্তাবিদদের ভুলে যায়, সে জাতি নিজের ভবিষ্যৎকেও প্রশ্নহীন করে তোলে।

সম্ভবত আমাদের এখন দরকার এক নতুন পাঠচক্র, যেখানে এই বিস্মৃত বাঙালি দর্শনচর্চাকারীদের চিন্তা নিয়ে আলোচনা হবে। যেখানে দর্শনের মানে হবে কেবল পাশ্চাত্যের নাম আওড়ানো নয়, বরং আমাদের নিজস্ব জমিতে জন্ম নেওয়া চিন্তাকে অনুভব করা। যে দর্শন নিছক তত্ত্ব নয়, বরং জীবনের সঙ্গী। যে দর্শন ‘আলোচনায়’ আসে না, কিন্তু ‘অনুভবে’ জেগে থাকে। যে দর্শনের মুখ থাকে না, কিন্তু স্পন্দন থাকে হৃদয়ে। এই নিঃশব্দ দর্শনই আমাদের নিজস্ব উত্তরাধিকার, আমাদের ভবিষ্যতের দিগন্ত।

Related

Scroll to Top