তুঝসে জুদা
“সদমা তো হ্যায় মুঝে ভি কে তুঝসে জুদা হুঁ ম্যায়”
জগজিৎ সিং তাঁর মৃত্যুর ঠিক এক সপ্তাহ আগে The Pioneer-কে দেওয়া শেষ সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন:
“আপনি যত সহজ ভাষায় কথা বলবেন, শ্রোতা তত গভীরভাবে আপনাকে অনুভব করবে।”
“আমি একজন গায়ক, যে গজলও গাইতে পারে।”
এইভাবে নিজেকে সংজ্ঞায়িত করতেন কিংবদন্তি গজলশিল্পী পদ্মভূষণ জগজিৎ সিং।
তিনি ২০১১ সালের ১০ অক্টোবর সকালে মৃত্যুবরণ করেন, মাত্র ক’দিন আগে, ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রেন হ্যামারেজ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন।
এই বছর তাঁর ৭০তম জন্মদিন উদযাপন করার ইচ্ছে ছিল—৭০টি কনসার্টের মাধ্যমে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে মাত্র ৪৬টি কনসার্টই সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন।
জগজিৎ সিং পণ্ডিত ছগনলাল শর্মা ও পরে উস্তাদ জামাল খানের কাছে সংগীত শিখেছিলেন। ১৯৭০ ও ৮০’র দশকে তিনি বিখ্যাত হন তাঁর কোমল কণ্ঠস্বর এবং গজলের ভিন্ন ধারার উপস্থাপনার জন্য।
১৯৪১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, রাজস্থানে এক শিখ পরিবারে জন্ম। পরবর্তী সময়ে হরিয়ানার কুরুক্ষেত্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৬৫ সালে মুম্বাইয়ে পাড়ি জমান গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার আশায়। শুরুটা কঠিন ছিল—ছোট গানের অনুষ্ঠান, বাড়ির কনসার্ট, সিনেমার পার্টিতে গান গাওয়া—এই সবই ছিল প্রতিদিনের অংশ।
তবুও তিনি আশা হারাননি।
এই সাক্ষাৎকারে, সম্ভবত তাঁর শেষ সাক্ষাৎকারে, তিনি বলেছিলেন—
“সবই ঈশ্বরের কৃপা। একসময় গজল কেবল ব্যক্তিগত অনুষ্ঠানে গাওয়া হতো, যেখানে ৬০-৭০ জন বোদ্ধা শ্রোতা থাকত। এখন তা বড় বড় কনসার্টে গাওয়া হচ্ছে হাজার হাজার মানুষের সামনে। তাই আজকাল আমি এমন গজলই গাই যাতে মানুষ নিজেকে খুঁজে পায়। তিন ঘণ্টার কনসার্টে শ্রোতাদের আগ্রহ ধরে রাখা জরুরি। যেন এক মুহূর্তের জন্যও যেন তারা বিরক্ত বা ক্লান্ত না হয়।”
গজলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি বলেছিলেন—
“এটা খুব কষ্টের কথা, কিন্তু হ্যাঁ, আমারও মনে হয় ধীরে ধীরে গজল হারিয়ে যেতে পারে। যদিও আমি বলছি না যে আর কেউ নেই। অনেক প্রতিভাবান শিল্পী আছেন। কিন্তু যদি উর্দু ভাষা বাঁচে, তবে গজলও বাঁচবে। আমি মনে করি সরকার উর্দুকে পাঠ্যক্রমে বাধ্যতামূলক করা উচিত। মানুষ যদি ভাষা বোঝে, তবে তারা গজলও বুঝবে।”
তিনি গজলের বাদশা ছিলেন, কিন্তু রাম ধুন ও নিবেদন-এর মতো ভক্তিমূলক গানেও সমান দক্ষতা দেখিয়েছেন।
“গজলের জনপ্রিয়তা কমছে, কারণ তরুণ প্রজন্ম বলিউড গানে বেশি আগ্রহী। কিন্তু মনে রাখবেন, তাদের বাবা-মা এখনো গজলে আগ্রহী। সৌভাগ্যক্রমে, এখনো আমি ভালো চাহিদায় আছি। সময় বদলেছে, মানুষের জীবনযাপন, পোশাক, আচরণ—সবই বদলেছে। গজলের উপস্থাপনাও বদলেছে—এখন গানের কথা অনেক সহজ।”
“গালিব আজ থেকে আড়াইশো বছর আগে সহজ ভাষায় কবিতা লিখেছিলেন—হাজার খোয়ায়িশে অ্যায়সি… এটা একটা এমন গজল, যেটা সবাই বুঝতে পারে।”
১৯৯০-এর দশকে তিনি “নীম কা পেড়” টিভি ধারাবাহিকের জন্য যে শিরোনাম সংগীতটি গেয়েছিলেন, সেটি লিখেছিলেন নিদা ফাজলি। এটি আজও মানুষকে টিভির পর্দায় টেনে আনে।
“আপনি যত সহজ ভাষায় গান গাইবেন, শ্রোতা তত আপনাকে ভালোবাসবে। ভালো গানের সৌন্দর্য সহজ কথার মধ্যেই লুকানো। এই জন্যই তো ‘ইয়ে দৌলত ভি লে লো, ইয়ে শোहरত ভি লে লো…’ এই গজলটি সবাই পছন্দ করে। এটা হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মানুষ আবেগে ভেসে যায়, শৈশবে ফিরে যায়।”
তিনি হতাশ ছিলেন বাস্তবতা শো ভিত্তিক প্রতিযোগিতাগুলোর কারণে।
“ছেলেমেয়েরা ভাবে ওখানে গান গাইলেই তারকা হয়ে যাবে। হ্যাঁ, ওরা একটা প্ল্যাটফর্ম পায় ঠিকই, কিন্তু সেখানে ওদের শুধু ফিল্মি গান গাইতেই হয়। ওরা নিজেদের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ করতে পারে না। গজল বা ধ্রুপদী গান সেখানে নেই বললেই চলে।”
তিনি বিশ্বাস করতেন ধৈর্য এবং সাধনার শক্তিতে—
“যদি তোমার ধৈর্য থাকে, তাহলে শিখে যাওয়ার অর্ধেক পথ তুমি পেরিয়ে গেছো। রাগ শিখতে হয় মনপ্রাণ দিয়ে। আজকাল শিল্পীরা ‘ফিউশন’ করতে চায়—তারা রাতারাতি জনপ্রিয় হতে চায়। কিন্তু এটা পুরোপুরি ওদের দোষ নয়—এই সমাজটাই তো আজ এত তাড়াহুড়োর। আমি পুরনো ধ্যানধারণার মানুষ নই, তবে কিছু মৌলিক নিয়ম মেনে চলা উচিত।”
তাঁর কনসার্ট ছিল এক পরম আনন্দের উৎস।
“সাঁও দা মাহিনা” গাইলে তাঁর কণ্ঠে যেন বসন্ত নামে, শ্রোতারাও খুশিতে আত্মহারা হয়ে যায়।
তিনি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ীর লেখা কবিতায় দুটি অ্যালবামে কণ্ঠ দেন—নয়ী দিশা (১৯৯৯) এবং সম্বেদনা (২০০২)।
জীবনের শেষদিকে তিনি বলিউড থেকে দূরে সরে যান—
“ওখানে এখন টাকা, টাকা আর টাকা। কিন্তু আমি শিল্পের জন্য গান গাই। আমি কেবল গজলশিল্পী নই, আমি একজন গায়ক। আমি যেকোনো গান গাইতে পারি। সৌভাগ্যবশত, মানুষ আমার গজল পছন্দ করে, আমার ভজনও।”
লিখেছেন চিত্রা সিং
শেষ সাক্ষাৎকার: জগজিৎ সিংয়ের আত্মকথন
Chitra Singh
আরো পড়ুন
Who Was Fakir Lalon Shah? The Baul Philosopher Who Transcended Religion
October 15, 2025
There’s a dust road that winds along the banks of the Kaliganga River in Kushtia,
সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার ও লাসলো ক্রাসনাহোরকাই
October 9, 2025
২০২৫ সালের সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন হাঙ্গেরিয়ান লেখক লাসলো ক্রাসনাহোরকাই, যিনি তাঁর অনন্য রচনাশৈলী ও
ড্যান ব্রাউনের নতুন থ্রিলার The Secret of Secrets
September 11, 2025
রহস্য, ইতিহাস, সিম্বলিজম এবং দমবন্ধ করা থ্রিলার এই চারটি শব্দ শুনলেই আমাদের মনে প্রথমে যে
এলিফ শাফাকের সাক্ষাৎকার: “আমি নিঃস্বরদের কথাই বলি”
June 17, 2025
এলিফ শাফাকের প্রিয় বই ও সাহিত্যিক প্রেরণার গল্প। ছোটবেলায় কোন বই তার কল্পনাকে ঝড় তুলেছিল,