এলিফ শাফাকের সাক্ষাৎকার: "আমি নিঃস্বরদের কথাই বলি" | Lipikola

এলিফ শাফাকের সাক্ষাৎকার: “আমি নিঃস্বরদের কথাই বলি”

প্রশ্ন: ছোটবেলায় পড়া এমন একটি বইয়ের কথা বলুন যা আপনাকে খুব টেনেছিল। কোন দিকটা আপনার কল্পনাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, এবং সেটি কি এখনো আপনার সঙ্গে রয়ে গেছে? এলিফ শাফাক: আ টেল অব টু সিটিজ। তখন গ্রীষ্মকাল। আমার নানী আমাকে ইজমিরে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে আমাকে আমার দাদীর বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন যেন আমি বহু বছর পর আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারি। এক ধরনের অদ্ভুত, বিষণ্ণ ও একাকী গ্রীষ্ম ছিল সেটা।তখনই আমি প্রথম চার্লস ডিকেন্সের বই পড়ি, কারণ এই বইটি তখনই প্রথমবার তুর্কি ভাষায় গ্রাফিক নভেল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পুরো গ্রীষ্মজুড়ে আমি এই বইটি বহুবার পড়েছি, সব ছবি রঙ করে ফেলেছিলাম—বনেট, বাড়ি, মদের পিপে, গিলোটিন। ডিকেন্স আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। প্রশ্ন: এমন কোনো বইয়ের কথা বলুন যা আপনাকে লেখক হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। কীভাবে সেটি আপনার সৃজনশীল যাত্রা শুরু করতে সাহায্য করেছিল? লেখক হিসেবে আপনার ভঙ্গি বা আকাঙ্ক্ষায় কী প্রভাব ফেলেছিল? এলিফ শাফাক: ডন কিহোতে—মিগেল দে সারভান্তেসের লেখা। যখন আমি প্রথম মাদ্রিদে এটি পড়ি, তখন আমি কিশোরী। সেই বই আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, অনুপ্রাণিত করেছিল, এবং আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছিল।আমি এমন এক পরিবেশে বড় হয়েছি যেখানে মৌখিক গল্প বলার ঐতিহ্য ছিল—মধ্যপ্রাচ্য, বলকান, এশিয়া মাইনরের। গল্পগুলো ছিল বৃত্তাকার, সময় ও স্থানের বাইরে ভেসে বেড়াত। কিন্তু ডন কিহোতে আমাকে প্রথমবারের মতো উপন্যাসের এক বিস্ময়কর কাঠামোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়—একসঙ্গে অনেক স্তর, অনেক আবেগ, হাসি থেকে শুরু করে বিষণ্ণতা পর্যন্ত। এটি এমন এক গল্প বলার ধরন যা কল্পনা, সাহস, জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টিকে একসাথে বুনে ফেলে।এটি ছিল এক বই যা বইকে ভালোবাসে! এক বই যা পাঠ এবং সাহসের কথা বলে! আমি জীবনের বিভিন্ন সময়ে এই বই আবার পড়েছি এবং প্রতিবার আমার অভিজ্ঞতা নতুনভাবে জন্ম নিয়েছে। এটি আমাকে লেখক হিসেবে বদলে দিয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও আগে আমাকে একজন পাঠক হিসেবে বদলে দিয়েছে। প্রশ্ন: আপনার সর্বকালের প্রিয় উপন্যাস কোনটি? কীভাবে তা আপনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে? আপনি কি সাম্প্রতিককালে আবার সেটি পড়েছেন? এলিফ শাফাক: এখানে আমি দু’টি উপন্যাসের কথা একসাথে বলতে চাই। একটি হলো ভার্জিনিয়া উলফের Orlando। এই উপন্যাস আমার হৃদয়ে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই বই পড়ার আগে আমি জানতাম না যে একজন লেখক হিসেবে আপনি এতটা ঝুঁকি নিতে পারেন—একটি কাহিনী কল্পনা করতে পারেন যা সময়, ভূগোল, সংস্কৃতি, পরিচয়, স্মৃতি—সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। পুরো উপন্যাসটা যেন জলের মতো—বয়ে চলে, খোঁজে, রূপান্তরিত হয়। এই উপন্যাস আমার মধ্যে এক গভীর মুক্তির অনুভূতি তৈরি করে।আরেকটি হলো দস্তয়েভস্কির The Brothers Karamazov। এটি একসাথে আবেগময় ও দার্শনিক, অনুভূতিপ্রবণ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক। এটি বিশ্বাস, সংশয়, নৈতিকতা, স্বাধীন ইচ্ছা, ইতিহাস, পরিবার, ব্যক্তি পরিচয় বনাম সামষ্টিক পরিচয়—এমন সব কঠিন বিষয় নিয়ে ভাবায়। আমি ভালোবাসি এই বইয়ের চরিত্রগুলোর বহুমাত্রিকতা এবং এর কাঠামোর জটিলতা—এগুলো কখনোই একরৈখিক নয়, বরং একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। এই জটিলতা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রশ্ন: আপনার উপন্যাস 10 Minutes 38 Seconds in This Strange World, যা ২০১৯ সালে বুকার পুরস্কারের জন্য শর্টলিস্টেড হয়েছিল, ইস্তানবুলে এক যৌনকর্মীর বাস্তব মৃত্যু দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই ঘটনার কোন দিকটি আপনাকে উপন্যাস লিখতে বাধ্য করল? এবং কেন আপনি প্রায়ই সমাজের প্রান্তিক মানুষদের নিয়েই লেখেন? এলিফ শাফাক: একজন লেখক হিসেবে আমি শুধু গল্প ও গল্প বলার ধরনেই আগ্রহী নই, আমি সেই নীরবতা আর নিঃশব্দতার দিকেও আকৃষ্ট হই—যারা সমাজে অবদমিত, যাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। আমি সবসময় ভাবি, আমার সমাজে সেই নিঃশব্দ অঞ্চলগুলো কোথায়? আর কাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে রাখা হয়েছে? ইস্তানবুলে একটা কবরস্থান আছে যেখানে আমি মাঝেমাঝে যেতাম—এর নাম সঙ্গীহীনদের কবরস্থান (The Cemetery of the Companionless)। বিগত কয়েক বছরে এটি দ্রুত বেড়ে উঠেছে। বিশাল এক জায়গা। এখানে সমাজ থেকে বর্জিত মানুষদের সমাধিস্থ করা হয়—যৌনকর্মী, এইচআইভি-সম্পর্কিত রোগে মৃত ব্যক্তিরা, আত্মহত্যাকারী, এমন অভিবাসীরা যারা ইউরোপে পৌঁছাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন… এরা সবাই এখানে পাশাপাশি শুয়ে আছেন। তাদের কবরে কোনো নাম নেই, শুধু নম্বর। এটা এমন এক জায়গা, যেখানে একজন মানুষকে নাম থেকে সরিয়ে সংখ্যা বানিয়ে ফেলা হয়, গল্পকে স্তব্ধ করে ফেলা হয়। আমার উপন্যাসে আমি সেটাকেই উল্টে দিতে চেয়েছি—উল্টো করে দেখতে চেয়েছি। আমি চাইছিলাম ঐ কবরে লেখা নম্বরগুলোর মধ্যে একটা বেছে নিয়ে তাকে একটা নাম দিতে, একটা গল্প দিতে, কিছু বন্ধু দিতে, যেন মানবতাহীনতার সেই প্রক্রিয়াটাকে ফেরত নেওয়া যায়। প্রশ্ন: 10 Minutes… উপন্যাসে মানবাধিকার, লিঙ্গ, যৌনতা ও প্রান্তিকতার মতো সামাজিক বিষয় উঠে এসেছে। আপনি কীভাবে মনে করেন, কথাসাহিত্য এই ধরনের বিষয়গুলোকে স্পর্শ করতে পারে বা ভূমিকা রাখতে পারে? এলিফ শাফাক: গল্প বলার শিল্প peripheral বা প্রান্তিকতাকে কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পারে। অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করতে পারে, অস্ফুট কণ্ঠকে কিছুটা শোনা যেতে দিতে পারে। আমি এমন এক দেশ থেকে এসেছি, যেখানে সামাজিকভাবে সামষ্টিক বিস্মৃতির (collective amnesia) প্রবণতা অনেক গভীর। তুরস্কের ইতিহাস দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ হলেও স্মৃতি ঠিক ততটা শক্তিশালী নয়। বরং উল্টোটা—ইতিহাস প্রায় সবসময় পুরুষদের গল্প হয়, ক্ষমতাবান পুরুষদের গল্প। তা কখনোই ‘her-story’ বা নারীদের গল্প নয়। গরিব বা সংখ্যালঘু পুরুষদের গল্পও নয়।আপনি যখন প্রশ্ন তুলবেন—এই গল্পটা কে বলছে? এবং কাকে বলতে দেওয়া হয়নি? তখন পুরো দৃশ্যটাই বদলে যায়। একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমি সেই অনকথিত গল্পগুলোতে আগ্রহী—নারীদের গল্প, সংখ্যালঘুদের গল্প, যেগুলো ‘সুবিধাজনকভাবে’ ভুলে যাওয়া হয়েছে বা মুছে ফেলা হয়েছে এইসব বিষয় সহজ নয়, এগুলো নিয়ে লিখলে অনেক সমালোচনা, এমনকি আক্রমণও আসে। কিন্তু উপন্যাস হল এমন এক সাহিত্যের ধরন যেখানে রয়েছে সূক্ষ্মতা, বহুমাত্রিকতা, সহানুভূতি—এটি যেন নির্বাসনের মধ্যে এক আশ্রয়, এক দরকারি আশ্রয়স্থল। প্রশ্ন: 10 Minutes… উপন্যাসে স্থান বা লোকালয়ের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইস্তানবুল সেখানে এক শক্তিশালী পটভূমি হিসেবে এসেছে—তার গন্ধ, শব্দ, রং, অনুভবসহ। আপনার লেখায় এই ‘স্থানচেতনা’ কতটা জরুরি? এলিফ শাফাক: স্থান আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন অভিবাসী লেখক হিসেবে, আমি প্রায়ই ‘অন্তর্ভুক্তি’ আর ‘বহির্ভুক্তি’র বিষয়ে ভাবি। বাস্তবতা হলো—আমরা কি একের অধিক ঘর বা পরিচয়ে থাকতে পারি? এই পৃথিবীতে, যেখানে আমাদের একটি নির্দিষ্ট ঘর বা শ্রেণিতে আটকে দেওয়া হয়, সেখানে কি আমরা একসঙ্গে বহুজাতিক বা বহুস্থানীয় হতে পারি?এই প্রশ্নগুলো আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবন আমাকে শিখিয়েছে, আপনি আপনার জন্মভূমি থেকে শারীরিকভাবে অনেক দূরে থাকলেও, মানসিকভাবে তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান না। আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে বয়ে বেড়াই—যেখানেই যাই না কেন।তাতে একটা বেদনাবোধ থাকে, ক্ষয়বোধ। একইসাথে, যুক্তরাজ্য এখন আমার ঘর হয়ে উঠেছে। এমনকি ইংরেজি ভাষাটাও। আমি আমার মাতৃভাষা ছেড়ে একটি ভিন্ন ভাষায় লিখি।তাই আমার জন্য স্থান, শেকড়, পরিচয়—সবকিছুই জটিল এক অভিজ্ঞতা। প্রশ্ন: আপনার অনেক উপন্যাসেই ‘ম্যাজিকাল রিয়ালিজম’ বা জাদুবাস্তবতার উপাদান লক্ষ করা যায়। আপনি এই শৈলীতে এতটা আগ্রহী কেন? এবং কোন লেখকরা আপনাকে এই ঘরানায় প্রভাবিত করেছেন? এলিফ শাফাক: আমি Gabriel Garcia Marquez, Toni Morrison কিংবা Jorge Luis Borges-এর মতো লেখকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রাখি—যারা জাদুবাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা প্রত্যেকে আমার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছেন।তবে আমি মনে করি, আমাদের এই ‘ম্যাজিকাল রিয়ালিজম’ নামক শ্রেণিবিভাগটাকেও

এলিফ শাফাকের সাক্ষাৎকার: “আমি নিঃস্বরদের কথাই বলি” Read More »

বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কি বদলাচ্ছে? ২০২৫-এর পাঠ-চিত্র | Angan

বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কি বদলাচ্ছে? ২০২৫-এর পাঠ-চিত্র

বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কি বদলাচ্ছে? রবীন্দ্রনাথের আমলে ‘পাঠক’ শব্দটি ছিল কিছুটা বিশিষ্ট ও মর্যাদাপূর্ণ। সে এক ধৈর্যশীল, মনোযোগী শ্রোতা, যার চোখে বই ছিল শুধুই জ্ঞান নয়—একটি অভিজ্ঞতা, আত্মদর্শনের আয়না। কিন্তু সময়ের নদী বহু বাঁক পেরিয়ে এসেছে। একবিংশ শতকের প্রথম প্রান্তেই বইয়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কটি একটি জটিল, বহুস্তরীয় রূপ নিয়েছে। ২০২৫ সালে এসে ‘নতুন বাঙালি পাঠক’ ঠিক কেমন? তারা কী পড়ে, কেন পড়ে, কোথায় পড়ে? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমরা আবিষ্কার করি একটি বিচিত্র পাঠাভ্যাসের ভূগোল, যা প্রযুক্তি, সামাজিক পরিবর্তন এবং ব্যক্তিগত অভিরুচির এক সম্মিলন। পাঠের নতুন ভুবন ২০২৫ সালের বাংলাদেশে পাঠ শুধু বইয়ের পাতায় সীমাবদ্ধ নয়। স্মার্টফোনের স্ক্রল, ট্যাবের ই-বুক, ইনস্টাগ্রামের ক্যারোসেল পোস্ট, ইউটিউবের সাবটাইটেল, এমনকি পডকাস্টে শোনা সাহিত্যের টুকরো—এসবই এখন “পাঠ”। পাঠকেরা এখন ‘রিডিং’ এবং ‘কনজাম্পশন’-এর ভিন্নধর্মী মেলবন্ধনে বিশ্বাসী। তারা দ্রুত পড়ে, নির্বাচন করে পড়ে, আবার কখনো দীর্ঘদিন ধরে একটি বিষয় নিয়ে পড়ে। এমনকি কেউ কেউ পড়ার চেয়ে “শোনার” মধ্যেই পাঠের আরাম খুঁজে পায়। এই প্রজন্ম একদিকে যেমন মোবাইল অ্যাপস বা কাইন্ডলের মাধ্যমে ইংরেজি অনুবাদে দস্তয়েভস্কি বা মারকেজ পড়ছে, অন্যদিকে ফেসবুকে “আনপোস্টেড বাংলা কবিতা” বা সাবরিনা বৃষ্টির মতো তরুণ লেখকদের রিল-ভিত্তিক গদ্যে আকৃষ্ট হচ্ছে। পাঠের এই পরিবর্তন শুধু মাধ্যমের নয়, মনোভঙ্গিরও। সাহিত্য বনাম ইনফোটেইনমেন্ট বই পড়া মানেই যে সাহিত্য পড়া, এই ধারণা আজ আর স্থির নয়। নতুন পাঠক গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি আত্মজীবনী, ফ্যাক্টচেক ভিত্তিক ইতিহাস, ব্যক্তিগত উন্নয়নমূলক লেখা, এমনকি গভীর রাজনৈতিক বিশ্লেষণেও আগ্রহী। “সাহিত্য” এখন অনেকটাই জায়গা ছাড়ছে “ইনফোটেইনমেন্ট” বা তথ্য+বিনোদনের মিশ্রণকে। একটি সময় ছিল যখন “কোন বই পড়ছো?” প্রশ্নটি আসত মানসিক বা শৈল্পিক উন্নয়নের লক্ষ্যে। এখন “পড়ছো কেন?” প্রশ্নের জবাবে পাওয়া যায়— “ক্যারিয়ারের জন্য,” “মানসিক হেলথের জন্য,” “ব্রেকআপ সামলাতে,” অথবা “নিজেকে বোঝার জন্য।” অর্থাৎ পাঠকের উদ্দেশ্য অনেক বেশি ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আত্মসম্মান-নির্ভর। পাঠকের বয়স ও শ্রেণি চিত্র নতুন পাঠকদের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ১৫-৩৫ বছরের তরুণ-তরুণীরা। শহর ও গ্রামীণ এলাকায় তাদের পাঠাভ্যাসে ভিন্নতা থাকলেও মোবাইল ফোনের কারণে এই ব্যবধানও অনেক কমে এসেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইয়ের রিভিউ, লেখকের লাইভ অনুষ্ঠান, ইউটিউব বুক রিভিউ চ্যানেল, কিংবা “বই নিয়ে আড্ডা”—এইসব প্ল্যাটফর্ম পাঠকদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করছে। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা যেমন ‘Rokomari’-তে অর্ডার করে হুমায়ূন আহমেদের বই বা ‘Baatighar’-এর নতুন সাহিত্য সিরিজ সংগ্রহ করছে, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা “নন-ফিকশন” জগতের দিকে ঝুঁকছে। নারীদের মধ্যে আত্মজীবনী, সাইকোলজি, এবং নারীবাদভিত্তিক সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। পাঠাভ্যাসে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব একজন পাঠক আজকাল যেভাবে বই পড়েন, তার পেছনে অনেকখানি অবদান সোশ্যাল মিডিয়ার। ইনস্টাগ্রামের ‘বুকস্টাগ্রামার’ কালচার, ফেসবুকের বই রিভিউ গ্রুপ, কিংবা টিকটকের “BookTok” আন্দোলন—সব কিছু মিলিয়ে পাঠ এখন শুধু একান্ত একাকী সাধনা নয়, একটি সামাজিক অংশগ্রহণ।এমনকি অনেকেই বই কেনেন একটি সুন্দর কভারের জন্য বা একটি লাইনের জন্য, যা তারা শেয়ার করতে পারেন নিজের টাইমলাইনে। ফলে প্রকাশকরা এখন বইয়ের বিষয়বস্তু যেমন ভাবেন, তেমনি ভাবেন ডিজাইন, টাইটেল, এমনকি “ইনস্টাগ্রাম-ফ্রেন্ডলি” কভার নিয়েও। নতুন লেখক, নতুন পাঠক ২০২৫ সালে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যারা পড়ছে, তারাই লিখছে। একদিকে যেমন পুরনো লেখকেরা নিজেকে নতুন করে উপস্থাপন করছেন (যেমন: সেলিনা হোসেনের ফেসবুক লেখা), অন্যদিকে তরুণ লেখকেরা সরাসরি সোশ্যাল মিডিয়ায় গদ্য, কবিতা বা চিন্তা প্রকাশ করছেন এবং সেখান থেকেই পাঠক তৈরি হচ্ছে। স্ব-প্রকাশনার সুযোগ, অনলাইন বুকস্টোর, কিংবা ই-বুক মার্কেটপ্লেসের ফলে লেখক হওয়াটা এখন অনেক বেশি সহজসাধ্য, এবং পাঠকরা নতুন লেখকদের প্রতি অনেক বেশি কৌতূহলী। এই দিক থেকে ‘দাগহীন’, ‘গল্পকার’, কিংবা ‘জিরো ডিগ্রি পাবলিকেশন’-এর মতো ছোট ছোট উদ্যোগগুলো উল্লেখযোগ্য। বইমেলা ও বিক্রয় ধারা একসময় বইমেলাই ছিল পাঠকের স্বর্গ। এখন তা আরও বৃহৎ, আরও বাণিজ্যিক, কিন্তু একইসঙ্গে আরও জনপ্রিয়। পাঠকরা বইমেলায় আসছেন শুধু বই কিনতে নয়, লেখককে দেখতে, ছবি তুলতে, লাইভ করতে, কিংবা অটোগ্রাফ নিতে। বই মেলা এখন একটি “ইভেন্ট”—যার ভিতরে বই আছে, বাইরেও অনেক কিছু। অনলাইন বিক্রয়ের প্রভাবে সারাবছর বই কেনার অভ্যাস গড়ে উঠেছে। রকমারি, বইপোকা, বইঘর, কাব্যবিন্যাসের মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলি শহর ছাড়িয়ে মফস্বলে পৌঁছে যাচ্ছে। পাঠের মানসিকতা ও ভবিষ্যৎ নতুন পাঠক বইয়ের মধ্য দিয়ে বাস্তবতা থেকে পালাতে চায় না, বরং বাস্তবতাকে বুঝতে চায়। তারা একটি বই পড়ে প্রশ্ন তোলে, সমালোচনা করে, নিজের জীবনের সঙ্গে মিল খোঁজে। এই পাঠক আরও সংবেদনশীল, আরও সচেতন। তবে তারা খুব বেশি ধৈর্যশীল নয়। ক্লাসিক বই পড়তে গিয়ে বিরক্ত হয়ে পড়ে, আবার ছোটগল্প বা গ্রাফিক নভেল তাদের কাছে আরও মনোগ্রাহী। ফলে প্রকাশকদেরও ভাবতে হচ্ছে, কীভাবে পাঠকের সময় ও রুচিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখা বা প্রকাশনা করা যায়। নতুন বাঙালি পাঠক একাধারে বিস্ময়কর এবং আশাব্যঞ্জক। তিনি হয়তো রবীন্দ্রনাথের মত দীর্ঘ কবিতা পড়ে না, কিন্তু তার মনোজগত, কৌতূহল, আত্ম-অন্বেষণ ও জিজ্ঞাসা প্রবল। তিনি বইয়ের পাতা না উল্টালেও স্ক্রিনে পাঠ খুঁজে পান, লেখকের সঙ্গে কথা বলেন, এবং কখনো নিজেই লেখক হয়ে ওঠেন। ২০২৫ সালে এসে বাঙালির পাঠাভ্যাস কোনো একটি ঘরানায় আটকে নেই। বরং তা এক বহুবর্ণিল, চলমান, পরীক্ষণধর্মী একটি অভিজ্ঞতা। বই, পৃষ্ঠা, পডকাস্ট, পোস্ট, ভিডিও—সব মিলিয়ে ‘পাঠ’ এখন আর কেবল নীরব নিভৃত এক সাধনা নয়, বরং তা হয়ে উঠেছে এক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও আত্মিক যাত্রা।

বইয়ের প্রতি ভালোবাসা কি বদলাচ্ছে? ২০২৫-এর পাঠ-চিত্র Read More »

দর্শনের পথিক অথচ ইতিহাসে অনুপস্থিত: বাংলার বিস্মৃত দার্শনিকরা | Angan

দর্শনের পথিক অথচ ইতিহাসে অনুপস্থিত: বাংলার বিস্মৃত দার্শনিকরা

বাংলার দর্শনের ইতিহাস মানেই যেন কয়েকটি পরিচিত নাম—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অরবিন্দ ঘোষ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর কিংবা পাশ্চাত্যের নামজাদা দার্শনিকদের ছায়া। কিন্তু এর বাইরেও ছিল এক বিস্মৃত চিন্তার জগৎ, যেখানে কিছু দার্শনিক, সাধক ও আত্মান্বেষী ব্যক্তিত্ব তাঁদের নিজস্ব পথ খুঁজে নিয়েছিলেন। তাঁদের কেউ হয়তো কোনো গ্রন্থ রচনা করেননি, কেউ গান বেঁধেছেন আত্মার ভাষায়, কেউবা নিভৃত গ্রামের মাটির ঘরে শিষ্যদের সামনে আত্মজিজ্ঞাসার অনুশীলন করেছেন। মূলধারার আলোচনার বাইরেই থেকে গেছেন তাঁরা, অথচ তাঁদের জীবন ও ভাবনা—উপেক্ষিত হলেও অসাধারণ। আজকের আলোচনায় সেই আড়ালে থাকা পথিকদের কথাই বলা হবে, যাঁরা বাংলার নিজস্ব দর্শনকে নিঃশব্দে বহন করে চলেছেন যুগের পর যুগ। এইসব নামহীন বা বিস্মৃত প্রান্তিক দার্শনিকরা—তাঁদের নিয়ে কথা বলার সময় এখন। যখন চিন্তা আর অনুভবকে রিল ভিডিওতে গুছিয়ে দেওয়া হয়, তখন এই মানুষদের কথা নতুন করে ভাবার সময়। এখনকার যুগে প্রশ্নের চেয়ে উত্তরের দাম বেশি, কিন্তু এঁরা ছিলেন এমন চিন্তাবিদ, যাঁরা প্রশ্নকে শ্রদ্ধা করতেন, কারণ প্রশ্নই নতুন চিন্তার জন্ম দেয়। বাংলার ভেতরে ভেতরে দর্শনের একটি মাটি ছিল, যেটি বইয়ের পাতায় নয়, মানুষের হৃদয়ে, আচার-আচরণে, গান-গল্পে রচিত হয়েছে। আজ আমরা সেই শেকড়কে ভুলে যাচ্ছি। কিন্তু একবার যদি শোনো লালন ফকিরের প্রশ্ন—“পাগল মন কি কথা বোলে?”—তবে বুঝবে, সেখানে কত বড় দার্শনিকতা লুকিয়ে আছে। তার মধ্যে আছে অস্তিত্বের প্রশ্ন, আছে আত্মচেতনার খোঁজ, আছে বিশ্বাস আর সন্দেহের দ্বন্দ্ব। লালন ছিলেন এমন এক চিন্তক যিনি জাত-ধর্ম-সম্প্রদায়ের খাঁচা ভেঙে দিয়েছিলেন। তাঁর গান ছিল আত্মার মুক্তির গান। লালনের চিন্তা ছিল একধরনের জাগতিক সুফিবাদের প্রতিফলন, যেখানে তিনি মানবতাকেই ধর্ম বলে মেনেছেন। তার চিন্তার মধ্যেই ছিল দার্শনিক প্রতিস্পর্ধা—যেখানে একদিকে সামাজিক কাঠামোর বিরুদ্ধে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে আত্মানুসন্ধানের এক গভীর পথ উন্মোচিত হয়েছে। ঠিক তেমনি শাহ সুফি সাইদুল্লাহ, ফরিদপুরের সুফি আহমদ উল্লাহ, কিংবা ঢাকার অলিগলির মাওলানা শামসুজ্জামান—তাঁদের চিন্তা ছিল অভ্যন্তরের আত্মাকে জানার চেষ্টা। এঁরা সকলেই দর্শনের পথে হাঁটতেন, যদিও তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে বসে প্রবন্ধ লেখেননি। তাঁরা রাস্তায়, খানকায়, বা খেজুর পাতার ছাউনির নিচে বসে দর্শনের চর্চা করেছেন। চিন্তা ছিল তাঁদের জীবনের অংশ, তাঁরা কখনো সেটা আলাদা করে লেখেননি। তাই এঁদের সম্পর্কে জানাও কঠিন, কারণ তাঁরা পাণ্ডুলিপি রেখে যাননি, রেখে গেছেন কথার রেশ, আচার আর প্রভাব। আমাদের পাঠ্যবইয়ে স্থান না পেলেও, বাংলার বহু মুসলিম দর্শনচর্চাকারী ছিলেন, যাঁদের চিন্তা সময়কে অতিক্রম করেছে। যেমন, গাওসুল আজম দরবেশ তাঁর অনুসারীদের শিক্ষা দিয়েছিলেন “নফস”-এর বিপরীতে “রুহ” কীভাবে বিকশিত হয়। তিনি বলতেন, আত্মাকে জানা মানে সৃষ্টিকে জানা। তাঁর মতে, মানুষই সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসা, আর এই মানুষকে বোঝার মাধ্যমেই দর্শনের দরজা খুলে যায়। আবার আবুল কালাম শামসুজ্জামান শিশুদের শেখাতেন প্রশ্ন করা যেন হয় ঈমানের অংশ। এই ছোট ছোট বীজ রোপণ করেছিলেন যারা, তাঁরা দর্শনের কৃষক। তাঁদের জীবনযাপন, কথাবার্তা, সাধনা—সবই ছিল দর্শনের নিরব অথচ দৃঢ় বহিঃপ্রকাশ। তাঁরা জোর করে কোনো ভাবনা চাপিয়ে দেননি, বরং শিষ্যদের প্রশ্ন করার স্বাধীনতা দিয়েছেন। সুফি চিন্তার মূল ভিত্তিই ছিল এই—অভ্যন্তরীণ অনুভব ও জিজ্ঞাসার মধ্যে স্রষ্টার সঙ্গে সম্পর্ক খোঁজা। আর এই খোঁজটাই ছিল একধরনের পরমত সহিষ্ণুতা, যেখানে নিজস্ব ভাবনাকে অন্যের ভাবনার সঙ্গে শান্তভাবে বসতে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ, পূর্ববঙ্গ, এমনকি ত্রিপুরা-অসম অঞ্চলেও ছড়িয়ে আছেন এই চিন্তকেরা। কেউ গান গেয়েছেন, কেউ সাধনা করেছেন, কেউবা নিরবে আত্মজিজ্ঞাসার চর্চা করেছেন। তাঁদের কেউ আজ মৃত, কেউ আজও জীবিত কিন্তু বিস্মৃত। এই বিস্মৃতির কারণ বহুবিধ—রাজনীতি, ধর্মীয় মেরুকরণ, আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার সংকীর্ণতা, কিংবা গণমাধ্যমের অমনোযোগ। ফলত, এই দর্শনের ধারাগুলো আজ লোকজ স্মৃতির স্তরে এসে আটকে গেছে। তাঁদের কেউ লিপিবদ্ধ হননি ইতিহাসে, কিন্তু তাঁদের দর্শন ছড়িয়ে আছে লোকজ স্মৃতিতে। কেউ কেউ হয়তো লিপিবদ্ধও হয়েছেন, কিন্তু পাঠকের অগোচরে হারিয়ে গেছেন। যেমন ধরো মাওলানা আকরাম খাঁ, যিনি সাংবাদিকতার আড়ালে ইসলামি যুক্তিবাদী চিন্তা করতেন। কিংবা ড. আব্দুর রাজ্জাক—যাঁর চিন্তা ছিল আধুনিকতা বনাম ধর্মের জটিল সম্পর্ক নিয়ে। তিনি আমাদের শিক্ষা দেন কিভাবে পশ্চিমা রাজনৈতিক দর্শন ও ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের দ্বন্দ্বকে একসঙ্গে বিশ্লেষণ করা যায়। তাঁর শিক্ষার্থীরা বলেন, তিনি ক্লাসে বলতেন, “দর্শন হচ্ছে এমন একটি জায়গা, যেখানে সব যুক্তি, সব প্রশ্ন, সব সংশয় বসতে পারে।” কিছু বিস্মৃত বাঙালি দার্শনিক : এই নামগুলো আমাদের শেখায় যে দর্শন কেবল বড় বড় বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সে বেঁচে থাকে মানুষের প্রাত্যহিক জীবন, প্রশ্ন, বিশ্বাস ও প্রেমে। আমরা যখন আজকের টিকটকের যুগে দাঁড়িয়ে ভাবি যে “দীর্ঘ বাক্য কি টিকে থাকবে?”—তখন এই বিস্মৃত দর্শনচর্চাকারীরা আমাদের কানে ফিসফিস করে বলেন, “চিন্তা সময় চায়, আর সময়ই দর্শনের জন্মদাতা।”এইসব মানুষদের স্মরণ করাটা আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক দায়। যাঁদের নাম আমরা জানি না, অথচ তাঁদের চিন্তাই আমাদের অন্তঃশক্তিকে তৈরি করেছে, তাঁদের গল্পগুলো আমাদের জানা উচিত। কারণ যে জাতি তার চিন্তাবিদদের ভুলে যায়, সে জাতি নিজের ভবিষ্যৎকেও প্রশ্নহীন করে তোলে। সম্ভবত আমাদের এখন দরকার এক নতুন পাঠচক্র, যেখানে এই বিস্মৃত বাঙালি দর্শনচর্চাকারীদের চিন্তা নিয়ে আলোচনা হবে। যেখানে দর্শনের মানে হবে কেবল পাশ্চাত্যের নাম আওড়ানো নয়, বরং আমাদের নিজস্ব জমিতে জন্ম নেওয়া চিন্তাকে অনুভব করা। যে দর্শন নিছক তত্ত্ব নয়, বরং জীবনের সঙ্গী। যে দর্শন ‘আলোচনায়’ আসে না, কিন্তু ‘অনুভবে’ জেগে থাকে। যে দর্শনের মুখ থাকে না, কিন্তু স্পন্দন থাকে হৃদয়ে। এই নিঃশব্দ দর্শনই আমাদের নিজস্ব উত্তরাধিকার, আমাদের ভবিষ্যতের দিগন্ত।

দর্শনের পথিক অথচ ইতিহাসে অনুপস্থিত: বাংলার বিস্মৃত দার্শনিকরা Read More »

Friedrich Nietzsche

নিটশে কি এই প্রজন্মে রিলেভেন্ট?

আধুনিক সময়ের প্রতিবাদের ভাষা বদলে গেছে। ব্যানারগুলোতে এখন শুধু “ন্যায়বিচার চাই” লেখা থাকে না — লেখা থাকে “ন্যায়বিচার না পেলে শান্তি নয়”, “আমরাই ৯৯%”, “প্যালেস্টাইন মুক্ত হোক”, “ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার”, “পৃথিবীকে বাঁচাও”, “সীমানা নয়, সহাবস্থান চাই”। এই আন্দোলনগুলো যৌথ, এই দাবিগুলো বৈশ্বিক। কিন্তু প্রতিটি স্লোগানের মাঝখানে, প্রতিটি জমায়েতের ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকে একজন করে মানুষ — একক, দোদুল্যমান, কল্পনাপ্রবণ, সোশ্যাল মিডিয়াতে স্ক্রল করতে করতে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে চলা। এইখানেই কি নিটশেকে ডাকা যায়?ফ্রিডরিখ নিটশে — উনিশ শতকের জার্মান দার্শনিক, যিনি বলেছিলেন “ঈশ্বর মৃত”, যাঁর লেখার ভঙ্গি ছিল কবিত্বময়, যিনি ‘উবারমেনশ’ বা অতিমানবের কথা বলেছিলেন — তিনি কি আদৌ আজকের যুগের প্রতিবাদীদের জন্য প্রাসঙ্গিক? একজন লেখক যিনি ‘হিসাবি নৈতিকতা’-কে বিশ্বাস করতেন না, যিনি ‘হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া’ জনমতকেও সন্দেহের চোখে দেখতেন, তিনি কি ‘ভালো মানুষের আন্দোলনের’ পাশে থাকতে পারেন? হয়তো ঠিক সেই কারণেই তাঁকে আবার পড়া দরকার।কারণ নিটশে আমাদের শেখান, নিজেকে খুঁজে পাওয়া একটি কাজ — একটি ‘অ্যাক্ট’। তিনি বিশ্বাস করতেন, সমাজ আমাদের তৈরি করে তোলে। সমাজ আমাদের বলে দেয় আমরা কে, কীভাবে ভাববো, কী ভালো, কী মন্দ। কিন্তু ব্যক্তিসত্তার জন্ম হয় তখনই, যখন আমরা এই সব ধারণার মুখোমুখি হই — এবং প্রশ্ন তুলি। হ্যাশট্যাগ যুগে প্রশ্নের ভাষাআজকের যুগে, যখন আন্দোলনের ভাষা ফেসবুক পোস্ট আর ইনস্টাগ্রাম রিলে সীমাবদ্ধ, যখন আমরা একটি হ্যাশট্যাগে মিলিয়ে ফেলার চেষ্টা করি আমাদের পুরো অস্তিত্ব, নিটশে বলেন — দাঁড়াও। তুমি কীভাবে জানো তুমি যা ভাবছো তা সত্যিই তোমার নিজের ভাবনা? তুমি কী নিজেকে গড়ছো, না কি শুধুই অনুকরণ করছো? এইখানেই নিটশের ‘ইচ্ছাশক্তির দর্শন’ বা ‘will to power’-এর কথা আসে। তিনি বলতেন, এটি অন্যদের উপর ক্ষমতা বিস্তারের কথা নয় — এটি নিজের ভেতরের সেই সত্তাকে তৈরির কথা, যে নিজস্ব নৈতিকতা, নিজস্ব মূল্যবোধ নিয়ে সামনে এগোয়। নতুন প্রজন্মের অনেকেই আজ প্রতিবাদ করছে — জলবায়ু পরিবর্তন থেকে শুরু করে জাতিগত বৈষম্য, লিঙ্গ রাজনীতি থেকে শুরু করে শিক্ষার সুযোগ — তারা সাহসী, তারা সোচ্চার। কিন্তু অনেক সময় সেই প্রতিবাদের ভেতরে তাদের নিজের সত্তা হারিয়ে যায়। তারা কখনো একটি দলের অংশ হয়ে যায়, কখনো একটি আদর্শের ছায়ায় ঢেকে যায়। নিটশে আমাদের বলেন, প্রশ্ন করো। নিজের দলকে, নিজের বিশ্বাসকে, এমনকি নিজের ‘ভালো’ হবার চেষ্টাকেও প্রশ্ন করো। প্রশ্ন করো — আমি কি সত্যিই নিজেকে গড়ে তুলছি, না কি শুধু অনুসরণ করছি? নতুন প্রতিবাদ, পুরনো আত্ম-অনুসন্ধানতাঁর চোখে, আসল প্রতিবাদ হলো নিজের ভিতরের স্ববিরোধিতা, দ্বিধা, সংশয় — এসবকে আলিঙ্গন করা। আসল সংগ্রাম হলো নিজের ভেতরে থাকা স্বরকে জাগিয়ে তোলা, এমনকি তা যদি জনপ্রিয়তার বিরুদ্ধে যায়। আজকের নতুন প্রতিবাদকারীরা যদি নিটশেকে পড়েন, তাঁরা হয়তো একটা নতুন ধরনের প্রশ্ন করতে শিখবেন — কেবল “এই অবিচার কেন?” নয়, বরং “আমার অবস্থান কী?”, “আমার মূল্যবোধ কি নিজস্ব?”, “আমি যা বলছি, তা সত্যিই বিশ্বাস করি তো?” নিটশে কখনোই আমাদের বলেননি কী ভাবতে হবে, বরং কেমন করে ভাবা উচিত — সে কৌশল তিনি শেখাতে চেয়েছেন। তাঁর কাছে আত্ম-অনুসন্ধান মানে ছিলো এক ধরনের বিপ্লব। এই বিপ্লব বাহ্যিক নয়, এটি চেতনার ভিতর ঘটে। এইখানে কোনো মিছিল নেই, কিন্তু আছে একাকী রাতের নিঃশব্দ প্রশ্ন, নিজের ভুল মেনে নেওয়ার সাহস, এবং জনপ্রিয় মতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর দৃঢ়তা।সামষ্টিকতার জোয়ারে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রতিটি স্লোগান আর ব্যানার একত্রিত করে তোলে মানুষকে, নিটশে আবার মনে করিয়ে দেন — ‘তুমি কে?’ এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাই আসল বিপ্লব।এবং সেই উত্তর খুঁজতে খুঁজতেই, আমাদের নতুন প্রজন্ম একদিন বুঝবে — নিটশে ছিলেন শুধুই দার্শনিক নন, তিনি ছিলেন আত্ম-আবিষ্কারের সবচেয়ে দুর্দান্ত চ্যালেঞ্জ।

নিটশে কি এই প্রজন্মে রিলেভেন্ট? Read More »

টিকটকের সময়ে রবীন্দ্রনাথ: দীর্ঘ বাক্যের কী হবে?

টিকটকের সময়ে রবীন্দ্রনাথ : আজকের যুগে টিকতে পারবে?

আমি সেদিন ‘শেষের কবিতা’ পড়া শুরু করেছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এসে চুপচাপ একটা বেঞ্চে বসে ছিলাম। পাশেই কফির কাপ, মোবাইলটা সাইলেন্টে। পৃষ্ঠা উল্টে পড়তে পড়তে যখন লাবণ্য আর অমিতের কথোপকথন এলো, একটা মুহূর্তে আমার মনে হলো—“আরে, একটা বাক্য এত দীর্ঘ কেন?” একটা বাক্যই যেন একটা ছোটগল্প! ক্লজের পর ক্লজ, উপমার পর উপমা। সেদিনের মতো পড়া বন্ধ করে দিলাম। পরে বাসায় ফিরে ইনস্টাগ্রামে ঢুকেই দেখি—“10 Books You Must Read in 2025” রিল ঘুরছে। ১৫ সেকেন্ডে ১০টা বই রিভিউ। চমকপ্রদ ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক, বড় বড় লেখা, দ্রুত গতির ভিজ্যুয়াল। মনটা সেখানেই আটকে গেল। এই দুই অভিজ্ঞতার মাঝে ফারাক শুধু মাধ্যমের না, চিন্তারও। একটা ধীরে, গভীর। অন্যটা দ্রুত, চটকদার। প্রশ্নটা উঠলো—রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ বাক্য আমাদের জন্য এখন কি অলসতা, না কি ধ্যান? দীর্ঘ বাক্য বনাম ছোট মনোযোগ রবীন্দ্রনাথের লেখায় দীর্ঘ বাক্য শুধু ভাষার খেলা নয়, এটা এক ধরণের মানসিক অভ্যাস। প্রতিটি বাক্য যেন একেকটা হাঁটা পথ। সে পথে আপনি ধীরে ধীরে হাঁটবেন, মাঝে মাঝে দাঁড়াবেন, চারপাশ দেখবেন, নিজের ভিতরের কথাগুলো শুনবেন। ধরা যাক, “সে নদীর স্রোতে ভেসে যাওয়া পাতার মতো ভেসে যাচ্ছিল, কোনো গন্তব্যের দিকে নয়, বরং এক অনির্দিষ্টতার মধ্যে।” — এমন বাক্য পড়লে কি সঙ্গে সঙ্গে বুঝে ফেলা যায়? না, পড়তে হয় ধীরে, একটু থেমে, বারবার। তখনি বোঝা যায়—এখানে কেবল গল্প বলা হচ্ছে না, একটা অভিজ্ঞতা তৈরি হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের পাঠের সাথে একটা নিরব সম্পর্ক তৈরি করতে চেয়েছেন। তাঁর বাক্য শুধু তথ্য দেয় না, চিন্তার অনুশীলনও শেখায়। আমরা আজ এমন এক যুগে বাস করছি, যেখানে মনোযোগই সবচেয়ে দুর্লভ সম্পদ। ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউব শর্টস—এসব প্ল্যাটফর্ম আমাদের শেখায় কীভাবে ৮ সেকেন্ডে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। “ভালো লাগছে?”—লাইক। “বোরিং?”—স্ক্রল। মনোযোগের এই ছেঁড়া ছেঁড়া অভ্যাস আমাদের ভাবনার গভীরতা কমিয়ে দিচ্ছে। বড় বাক্য পড়তে এখন ক্লান্তি লাগে, কারণ আমাদের মস্তিষ্ক এখন অভ্যস্ত ক্ষুদ্র ও দ্রুত খণ্ডে ভাবতে। একটা সময় ছিল যখন আমরা একটা বই হাতে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। এখন? মোবাইল হাতে থাকলে একটা নোটিফিকেশনেই মন বিঘ্নিত। রবীন্দ্রনাথের লেখায় প্রবেশ করতে হলে যা দরকার—সেই মনোযোগ, ধৈর্য, নিঃশব্দতা—তা আজ বিলাসিতা মনে হয়। আমি নিজে যখন লিখি, তখনও দ্বন্দ্বে ভুগি। পাঠক কি এত বড় বাক্য পড়বে? অনেকে তো প্রথম বাক্যই শেষ না করে ছেড়ে দেয়। “ছোট লেখো, পরিষ্কার লেখো”—এসব পরামর্শ আমাদের লেখালেখির দুনিয়ায় এখন প্রায় বাণী হয়ে উঠেছে। তবে কখনো কখনো আমি নিজেই লেখার মধ্যে হারিয়ে যাই। যখন একটা বাক্য শুরু করি আর মনে হয়, এই চিন্তাটা এখানে থামানো যাবে না। একটা ভাবনা অন্য ভাবনাকে ডাকে, একটা অনুভব আরেকটিকে জন্ম দেয়। তখন বাক্য নিজেই বড় হয়ে যায়। তখন লেখাটাই হয়ে ওঠে এক ধরণের জার্নি। ঠিক যেমনটা রবীন্দ্রনাথ করতেন। রবীন্দ্রনাথের বাক্যের ভেতর দিয়ে চিন্তার অনুশীলন রবীন্দ্রনাথের লেখায় যে লম্বা বাক্য, তা কিন্তু আত্মপ্রকাশের এক ধরণের দায়বদ্ধতা। চিন্তার সম্পূর্ণ রূপ প্রকাশের জন্য অনেক সময়ে ছোট বাক্য যথেষ্ট নয়। যেমন প্রেম, যেমন বেদনা, যেমন সংকট—সবকিছুরই বহুস্তর থাকে। যদি আমরা শুধু টিকটকের মতো প্ল্যাটফর্মে অভ্যস্ত হই, তাহলে দীর্ঘ বাক্যই হারিয়ে যাবে না, হারাবে একটি ধরণের অনুভব, অনুভবের গভীরতা। চিন্তা করার ক্ষমতা ক্ষীণ হয়ে পড়বে। সাহিত্য হবে কোটেশনের উৎস, সংবেদনশীলতার নয়। কিন্তু সাহিত্যের আসল কাজ তো আমাদের ভিতরকার অদেখা অংশগুলোকে দেখা, না? রবীন্দ্রনাথ লিখতেন মন্থর ভাষায়, কারণ মন্থরতা নিজেই ছিল একটি অবস্থান—বিশ্বকে বোঝার, গ্রহণ করার, এবং ভালোবাসার। আমরা যদি কেবল দ্রুততার জগতে বাঁচি, তবে হয়তো আমরা সাহিত্য নয়, শুধুই ‘কনটেন্ট’ পাব। এই প্রশ্ন অনেকেই করেন। রবীন্দ্রনাথ কি এখনকার তরুণদের জন্য প্রাসঙ্গিক? তাঁর ভাষা কি এতটাই “পুরনো” যে তা এখন আর টানে না? আমি বলবো—রবীন্দ্রনাথ এখনো আছেন, শুধু তাঁকে পাওয়ার জন্য আমাদের ভেতরের ছন্দ বদলাতে হবে। আমরা যদি ধৈর্য ধরি, শব্দের গভীরে নামি, তবে দেখব—তিনি এখনো কথা বলেন। আমার এক বন্ধু বলেছিল—“রবীন্দ্রনাথ পড়তে পড়তে আমি আমার ভেতরকার চিন্তাগুলোকে চিনতে শিখেছি। আগে যেগুলো ছিল এলোমেলো, তিনি সেগুলোকে ভাষা দিয়েছেন।” রবীন্দ্রনাথ আমাদের শিখিয়েছেন কিভাবে অনুভব করতে হয়। তিনি আমাদের চেতনার ভাষা। সেই ভাষা দ্রুত না হলেও সত্য। সে ভাষা এখনো আমাদের দরকার। রবীন্দ্রনাথকে পড়ার মানে এই নয় যে আপনাকে একসাথে গীতাঞ্জলি পড়ে শেষ করতে হবে। আপনি শুরু করতে পারেন—একটা কবিতা দিয়ে, একটা চিঠি দিয়ে (যেমন ছিন্নপত্র), একটা গান দিয়ে, আর তারপর তার পেছনের ভাবনাটা খুঁজে দেখে। পড়ার অভ্যাসটা ধীরে ধীরে গড়ে তুলুন। আপনি যখন মোবাইল বন্ধ করে দশ মিনিট শুধু একটা প্যারা পড়েন, তখনই একটা নীরবতা তৈরি হয়। সেই নীরবতার মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আসেন। তিনি আমাদের শেখান—থেমে পড়তে, দেখার আগেই না বুঝে ফেলতে, অনুভবের ভাষা খুঁজে পেতে। টিকটকের যুগে সেই শিক্ষা হয়তো দুর্লভ, কিন্তু অমূল্য। রবীন্দ্রনাথকে পড়া মানে বড় কিছু বোঝা নয়—বরং নিজের ভিতরের সেই অংশটুকু ছুঁয়ে ফেলা, যা প্রতিদিনের স্ক্রলিংয়ে হারিয়ে যায়। যদি আমরা সেই অংশটুকুকে আবার জাগাতে চাই, তাহলে আমাদের আবার পড়তে হবে—ধীরে, দীর্ঘভাবে, রবীন্দ্রনাথের মতো করে।

টিকটকের সময়ে রবীন্দ্রনাথ : আজকের যুগে টিকতে পারবে? Read More »

Marilyn-Monroe from kazirkaz

গ্ল্যামারের আড়ালে মেরিলিন মনরোর জীবন

ম্যারিলিন মনরো বিশ্বের অন্যতম খ্যাতিমান নারী হওয়ার আগে তার কৈশোর কেটেছে পালক পরিবার ও অনাথ আশ্রমে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন এবং একটি যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কারখানায় কাজ করতেন।ম্যারিলিন মনরো আধুনিক ইতিহাসের অন্যতম খ্যাতিমান নারী। একজন অনাথ আশ্রমে বেড়ে ওঠা কিশোরী থেকে হলিউডের প্রতীক হয়ে ওঠার তার রূপান্তর একটি অনন্য আমেরিকান সাফল্যের গল্প।তবে প্রশ্ন হলো, এই তরুণী ম্যারিলিন মনরো কীভাবে এটা সম্ভব করেছিলেন? একটা দুঃসময়ময় শৈশব কাটিয়ে—যার বেশিরভাগ কেটেছে অনাথ আশ্রমে ও পালক পরিবারের মধ্যে—ম্যারিলিন মনরো মাত্র ১৬ বছর বয়সে বিয়ে করেন, যাতে আবার রাজ্য হেফাজতে ফিরে যেতে না হয়।দুই বছর পর, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এক কারখানায় কাজ করার সময়ে এক আলোকচিত্রী তার দিকে নজর দেন—এবং তারপর থেকেই ইতিহাস গড়ে ওঠে। কিন্তু দ্রুত তারকা হয়ে ওঠার পরও, মনরো কখনোই তার অস্থির অতীত থেকে পুরোপুরি মুক্ত হতে পারেননি। ক্যারিয়ারের পরবর্তী সময়ে তিনি আসক্তি সমস্যায় ভুগছিলেন, আর শেষমেশ ১৯৬২ সালের আগস্টে, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বারবিচুরেট ওভারডোজে মারা যান। উপরে আপনি দেখতে পাবেন তরুণ ম্যারিলিন মনরোর কিছু দুর্লভ ছবি। আর নিচে—পড়তে পারবেন ইতিহাসের অন্যতম বড় তারকার শৈশব জীবন সম্পর্কে আরও অনেক অজানা তথ্য। তরুণ ম্যারিলিন মনরোর দুঃখভরা জীবন ম্যারিলিন মনরো জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৬ সালের ১ জুন, লস অ্যাঞ্জেলসে, নর্মা জিন মর্টেনসন নামে। জন্ম থেকেই তার জীবন ছিল অস্থির ও অনিরাপদ। তার মা, ২৪ বছর বয়সী গ্ল্যাডিস পার্ল বেকার, আগেই এক সহিংস পুরুষ, জাসপার বেকার-এর সঙ্গে বিয়েতে দুটি সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন। ১৯২১ সালে যখন গ্ল্যাডিস ডিভোর্সের আবেদন করেন, তখন জাসপার তাদের সন্তানদের নিয়ে কেন্টাকি পালিয়ে যান। এরপর ১৯২৪ সালে গ্ল্যাডিস আবার বিয়ে করেন মার্টিন এডওয়ার্ড মর্টেনসন-কে, তবে মাত্র কয়েক মাস পরেই তারা আলাদা হয়ে যান। তবুও, গ্ল্যাডিস জন্ম সনদে মর্টেনসনের নামই লেখেন নর্মা জিনের পিতার জায়গায় (যদিও তার নামের বানান ভুল ছিল)।পরে জানা যায়, ভবিষ্যতের এই তারকার আসল পিতা ছিলেন একজন বিবাহিত পুরুষ, যার নাম চার্লস গিফোর্ড—২০২২ সালে Variety পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এ তথ্য প্রকাশ পায়। নর্মা জিন জন্মের কিছুদিন পর গ্ল্যাডিস তার কন্যার নাম পালটে নিজের পদবি দেন, এবং মেয়েটি নর্মা জিন বেকার নামে বেড়ে ওঠে—যতদিন না সে নিজে ১৯৪২ সালে বিয়ে করেন। যখন ম্যারিলিন মনরো মাত্র দুই সপ্তাহ বয়সী, তখনই তার মা তাকে এক পালক পরিবারের কাছে রেখে দেন। প্রথম ছয় মাস মা গ্ল্যাডিস সেই পরিবারের সঙ্গেই থাকতেন, কিন্তু কিছুদিন পর থেকে তিনি কেবল সপ্তাহান্তে মেয়েকে দেখতে যেতেন। যখন মনরো সাত বছর বয়সী, গ্ল্যাডিস একটি বাড়ি কিনে তাকে স্থায়ীভাবে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই গ্ল্যাডিসের প্যারানয়েড স্কিজোফ্রেনিয়া ধরা পড়ে, এবং তাকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এর ফলে ছোট্ট নর্মা জিনকে আবার ফিরে যেতে হয় পালক পরিবারের সিস্টেমে। পরবর্তী এক দশক ধরে, ম্যারিলিন মনরোর জীবন কেটেছে পালক পরিবার ও অনাথ আশ্রমে ঘুরতে ঘুরতে। এই অস্থির, কঠিন সময়টাই পরবর্তীতে তাকে অভিনয়ের দিকে টানতে শুরু করে। তার মৃত্যুর কিছু আগে LIFE ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে, যা পরে ২০০৭ সালে The Guardian-এ পুনঃপ্রকাশিত হয়, ম্যারিলিন মনরো সাংবাদিক রিচার্ড মেরিম্যানকে বলেন: “আমার কিছু পালক পরিবার আমাকে দিনের বেলা সিনেমা হলে পাঠাতো যাতে আমি বাসা থেকে কিছুক্ষণ বাইরে থাকি। আমি সেখানে দিনের পর দিন, রাত গভীর পর্যন্ত বসে থাকতাম। সামনে বিশাল পর্দা, আর আমি—একটা ছোট্ট মেয়ে, একা বসে থাকতাম… আর আমি সেটা খুব ভালোবাসতাম।” ১৯৪২ সালে মনরো যে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তারা অন্য রাজ্যে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু ক্যালিফোর্নিয়ার আইন অনুযায়ী তারা ১৫ বছর বয়সী নর্মা জিনকে সঙ্গে নিতে পারতেন না। তাই মনরোর পালক মা তাদের প্রতিবেশী, ২১ বছর বয়সী জেমস ডগার্টি-র সঙ্গে মেয়েটির বিয়ে দেন। মনরোর ১৬তম জন্মদিনের কয়েক দিনের মধ্যেই বিয়ে সম্পন্ন হয়, যাতে তাকে আর অনাথ আশ্রমে ফিরে যেতে না হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ডগার্টি যখন সৈনিক হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে, তখন মনরো ক্যালিফোর্নিয়ার ভ্যান নাইসে একটি অস্ত্র কারখানায় কাজ করতে শুরু করেন।১৯৪৪ সালে, ছবির মাধ্যমে সেনাবাহিনীর মনোবল বাড়াতে, আলোকচিত্রী ডেভিড কনোভার সেই কারখানায় যান এবং মনরোর একটি ছবি তোলেন—যা আজ বিখ্যাত হয়ে উঠেছে।এই ছবির সূত্র ধরে মনরো ১৯৪৫ সালের আগস্টে ব্লু বুক মডেলিং এজেন্সিতে যুক্ত হন। এর ঠিক এক বছর পর, নর্মা জিন ডগার্টি সই করেন ২০থ সেঞ্চুরি ফক্স-এর সঙ্গে একটি চুক্তি, এবং গ্রহণ করেন সেই নাম—ম্যারিলিন মনরো—যা পরবর্তীতে বিশ্বের এক কিংবদন্তিতে রূপ নেয়। ম্যারিলিন মনরো কীভাবে হলিউডে খ্যাতি অর্জন করেন ক্যারিয়ারের শুরুতে, তরুণ ম্যারিলিন মনরো মডেলিং আর অভিনয়ের মধ্যে দুলছিলেন। তিনি Actors’ Laboratory Theater-এ অধ্যয়ন করে ইন্ডাস্ট্রির কৌশল শেখেন, ঠিক তখন যখন তিনি ২০থ সেঞ্চুরি ফক্সের চুক্তিতে ছিলেন। ১৯৪৮ সালে, তিনি সই করেন কলাম্বিয়া পিকচারস-এর সঙ্গে এবং Ladies of the Chorus সিনেমায় অভিনয় করেন, যা বক্স অফিসে ব্যর্থ হয়। কিন্তু এই হতাশার পরেও, তিনি হাল ছাড়েননি। তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন—নিজেকে সেরা বানাবেন। নিজের আত্মজীবনী My Story-তে তিনি লেখেন: “আমি জানতাম আমি কতটা তৃতীয় শ্রেণির (third rate)। আমি সত্যিই অনুভব করতাম, যেন আমার প্রতিভার অভাবটা আমার শরীরের ভেতর সস্তা কাপড়ের মতো জড়িয়ে আছে।কিন্তু, ঈশ্বর, আমি শিখতে চাইতাম! বদলাতে চাইতাম, উন্নত হতে চাইতাম!” ম্যারিলিন মনরোর প্রথম বড় সুযোগ আসে ১৯৫০ সালের ছবি The Asphalt Jungle-এর মাধ্যমে, যা বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করে।এই ছবির সাফল্যের কারণে মনরো আবারও একটি চুক্তি পান ২০শ শতাব্দীর ফক্সের সঙ্গে। সেই বছর, LIFE ম্যাগাজিন জানায়, সাংবাদিক এড ক্লার্ক স্টুডিওর একজন বন্ধুর কাছ থেকে ফোন পান, যে তাকে জানায় “একজন ‘হট টমেটো’” সম্প্রতি তাদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। এরপর ক্লার্ক লস অ্যাঞ্জেলসের গ্রিফিথ পার্কে গিয়ে ২৪ বছর বয়সী মনরোর কিছু ছবি তোলেন, যাকে তখন উজ্জ্বল উঠতি তারকা হিসেবে দেখা হচ্ছিল। ক্লার্ক পরে বলেন, “আমি অনেক রোল ছবি LIFE ম্যাগাজিনে নিউইয়র্ক পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তারা টেলিগ্রাম পাঠালো, ‘ম্যারিলিন মনরো কে?’”তবে দুই বছর পর মনরো সেই ম্যাগাজিনের কভার পেজে উঠেন। ম্যারিলিন মনরো দ্রুত ২০শ শতাব্দীর ফক্সের সবচেয়ে বড় তারকা হয়ে ওঠেন, এবং Gentlemen Prefer Blondes (১৯৫৩), Some Like It Hot (১৯৫৩), ও The Seven Year Itch (১৯৫৫) এর মতো চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। Gentlemen Prefer Blondes-এর মিউজিকাল দৃশ্য “Diamonds Are a Girl’s Best Friend” এবং তার আইকনিক স্কার্ট উড়ানোর সিকোয়েন্স দ্রুত পপ সংস্কৃতিতে গভীরভাবে প্রবেশ করে। তার খ্যাতি বাড়ার সময়ে, তরুণ মনরো তার প্রথম স্বামীর সঙ্গে তালাক নেন, ১৯৫৪ সালে নিউইয়র্ক ইয়াঙ্কিস দলের তারকা জো ডিমাজিও-র সঙ্গে বিয়ে করেন, কিন্তু এক বছর পর তাকে ছেড়ে দেন। ১৯৫৬ সালে তিনি নাট্যকার আর্থার মিলার-এর সঙ্গে বিয়ে করেন, যা ১৯৬১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হয়। তার প্রেমজীবন সবসময় সংবাদ শিরোনামে থাকত, বিশেষ করে যখন তার ইউএস প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এবং তার ভাই রবার্ট কেনেডি-র সঙ্গে সম্পর্ক থাকার গুঞ্জন ছড়ায়। ১৯৫০-এর দশকের শেষ নাগাদ, তরুণ ম্যারিলিন মনরো একটি পরিচিত নাম হয়ে ওঠেন, এবং তার উত্থান যেন অবসানহীন।কিন্তু সবকিছু শেষ হয়ে যায় যখন ১৯৬২ সালে তার গৃহকর্মী

গ্ল্যামারের আড়ালে মেরিলিন মনরোর জীবন Read More »

নজরুল: আগুনের ফুলকি, মানুষের কবি Angan

নজরুল: আগুনের ফুলকি, মানুষের কবি

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ, বাংলার প্রখর রৌদ্রে জ্বলে উঠেছে এক চেতনার দীপ্তিময় শিখা। আজ কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন—একশো ছাব্বিশ বছর আগে এই দিনে চুরুলিয়ার আকাশে এক বিদ্রোহী নক্ষত্রের উদয় হয়েছিল, যার আলো আজও নিভেনি, নিভবেও না। তিনি ছিলেন কেবল কবি নন—তিনি ছিলেন এক রণধ্বনি, এক স্বপ্ন, এক দুর্বার আকাঙ্ক্ষার নাম। কখনো আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠেছেন, আবার কখনো নদীর মতো শান্ত স্রোতে গান বেঁধেছেন প্রেমের, ভালোবাসার, মানবতার। নজরুল ছিলেন বিদ্রোহী, কিন্তু সেই বিদ্রোহে ছিল ভালোবাসা, ছিল করুণা, ছিল গভীর এক মুক্তির স্বপ্ন। যে সময়ে বাংলার হৃদয়ে দাসত্বের শৃঙ্খল, মৌলবাদ আর বৈষম্যের বিষবাষ্প জমে উঠেছিল—সেই সময়ে তিনি বজ্রকণ্ঠে বলেছিলেন, “আমি বিদ্রোহী, আমি বিশ্ববিধাতার কাছে করিয়াছি প্রতিবাদ!” এই প্রতিবাদ ছিল মানুষের পক্ষে, শোষিতের পক্ষে, এবং সত্য ও সৌন্দর্যের পক্ষে। কিন্তু নজরুল মানেই কেবল জাগরণের কবি নন। তিনি প্রেমের কবিও বটে—যে প্রেমে নেই কৃত্রিমতা, নেই বাধা। যে প্রেম অচেনা পথিকের চোখে খুঁজে নেয় আপনজনকে।তার কলমে প্রেম যখন উচ্চারিত হয়, তখন শব্দগুলো হয়ে ওঠে শরতের আকাশে উড়তে থাকা কাশফুলের মতো—“চাঁদ যদি রাত্রির চোখে স্বপ্ন হয়ে নামে,তবে তুই আমার ভালোবাসা—জীবনের চিরপ্রেমে।” নজরুলের লেখায় বারবার ফিরে এসেছে সমতা ও সাম্যের বার্তা। তিনি যখন বলেন—“মোরা এক বৃন্তে দুটি কুসুম হিন্দু-মুসলমান,” তখন তা শুধু পঙ্‌ক্তি নয়, হয়ে ওঠে ইতিহাসের এক স্পষ্ট দৃষ্টিকোণ। তাঁর সাহিত্য আজও ধর্মান্ধতার মুখে তির হয়ে বাজে, বিভেদের প্রাচীরে ধাক্কা দিয়ে বলে—ভালোবাসো, ভালোবাসো নিঃস্ব, শোষিত, পথহারা মানুষকে। তাঁর গান ছিল গানের চেয়েও বেশি কিছু। নজরুল-সঙ্গীত বাংলা মাটির হৃদয়। তাঁর সুরে ছিল আগুন, তাঁর ছন্দে ছিল ঝড়, তাঁর গলায় ছিল এক উদাত্ত আহ্বান—“চল্ চল্ চল্”—যা প্রতিধ্বনিত হয় প্রতিটি প্রতিবাদে, প্রতিটি নবযাত্রায়। শুধু যুদ্ধের গান নয়, শ্যামা-সঙ্গীত, ইসলামি সংগীত, রাগাশ্রিত গান—সবখানেই তিনি রেখে গেছেন তাঁর বিস্ময়কর সুরের স্বাক্ষর। ধর্ম ছিল তাঁর হৃদয়ের স্তব, কিন্তু বিভেদের দেয়াল ভাঙাই ছিল তাঁর সাধনা। দীর্ঘ নীরবতার অসুখ তাকে বাকরুদ্ধ করলেও, তার সৃষ্টি থেকে কোনোদিন থেমে যায়নি চেতনাধ্বনি। তিনি নিঃশব্দ থেকেও উচ্চারণ করেন আজও, “আমি কণ্ঠহারা, তবু কণ্ঠস্বরে বাঁচি।” স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানীতে যখন তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়, তখন তা ছিল শুধু কবিকে নয়, বাংলার প্রাণকে শ্রদ্ধা জানানো। তাঁর লেখা আজও পাঠ্য, প্রার্থ্য, প্রেরণা। নজরুল বেঁচে আছেন আমাদের প্রতিটি প্রতিবাদে, প্রতিটি ভালোবাসায়, প্রতিটি সাম্যের আকাঙ্ক্ষায়। নজরুল আছেন গ্রামীণ কোনো মঞ্চে মুখস্ত বলা কবিতায়, আবার আছেন নগরীর কোনো ব্যানারে, দেয়ালে, বুকের ভেতরে। তাঁর জন্মদিনে তাকে ফুল দিয়ে নয়, কণ্ঠে তুলে নিই তারই উচ্চারণ—“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর,অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।” আজকের দিনটিতে, আমরা যদি সত্যিই নজরুলকে ভালোবাসি, তবে তার মতো করে ভালোবাসতে শিখি মানুষকে, সংগ্রামকে, শিল্পকে।কারণ নজরুল কেবল কবি ছিলেন না, নজরুল ছিলেন বাংলা নামক আত্মার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। নজরুলের চেতনাকে বিনম্র শ্রদ্ধা, আগুনছোঁয়া ভালোবাসা।

নজরুল: আগুনের ফুলকি, মানুষের কবি Read More »

মা, তুমি আছো বলেই আকাশটা এখনো নীল

মা, তুমি আছো বলেই আকাশটা এখনো নীল

“মা”— এই এক অক্ষরের শব্দটি যেন বিশ্বজগতের সব আলো, সব উষ্ণতা, সব ভালোবাসার এক কেন্দ্রমণি। মা হলেন সেই অস্তিত্ব, যিনি নিজের জীবন দিয়ে গড়ে তোলেন আরেকটি জীবন। আর সেই জীবনকে তিনি শুধু জন্ম দেন না, তিনি তাতে ঢেলে দেন প্রার্থনার মত অদৃশ্য এক আশীর্বাদ।প্রথম আলোয় যাকে দেখি, তিনিই আমার মা জন্মের আগেই শুরু হয় মা ও সন্তানের অনন্য বন্ধন। মায়ের হৃদয়ে প্রথম যে স্পন্দন অনুভূত হয়, সেটিই সন্তানের অস্তিত্বের প্রথম চিহ্ন। আর সেই মুহূর্ত থেকে শুরু হয় এক অনন্ত পথচলা—যেখানে মায়ের জীবন, স্বপ্ন, রাতের ঘুম, সকালের শান্তি সবকিছুই সন্তানের মুখের হাসির সাথে জড়িত হয়ে পড়ে। মায়ের কোল মানেই পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়।মায়ের চোখ মানেই ভালোবাসার সবচেয়ে বিশুদ্ধ ভাষা।মায়ের কণ্ঠ মানেই প্রতিদিনের প্রার্থনার ছায়া। সন্তান কখনো কাঁদে, কখনো হাঁটে, পড়ে গিয়ে উঠে দাঁড়ায়, আবার ভুল করে—সবসময়ই মা থাকেন পাশে। তাঁর ভালোবাসা এমন এক তরঙ্গ যা কখনো কমে না, বরং সময়ের সাথে গভীর হয়। মা, তুই যেন এক অনন্ত জলধি—যার গভীরতা মাপতে পারিনি আজওমা শুধু একজন নারী নন। তিনি প্রকৃতি। তিনি সৃষ্টি। তিনি পৃথিবীর প্রথম গল্পকার, যিনি নিঃশব্দে আমাদের জীবনের প্রতিটি অধ্যায় লিখে যান স্নেহ আর ত্যাগের অদৃশ্য কালিতে। তিনি সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য নিজের আজকে বিসর্জন দেন, হাসিমুখে। নিজের স্বপ্নগুলোকে তুলে রাখেন আলমারির এক কোনে, শুধুমাত্র সন্তানের মুখে হাসি দেখার আশায়। “মা, আজ তোমার হাতের ভাতটা খুব মনে পড়ছে”—এই একটুখানি বাক্যের ভেতর লুকিয়ে থাকে কতশত বিকেল, কতোশত স্মৃতি, কতোশত আদর। মায়ের মমতা যেন শরতের নীল আকাশ—বিস্তৃত, নির্মল, অথচ ছোঁয়া যায় না। তাঁর ভালবাসা যেন নদীর মত—অবিরত প্রবাহমান, জীবনের প্রতিটি মোড়ে আমাদের তৃষ্ণা মেটায়। সন্তানের ভালোবাসা—অন্তরালের এক অদৃশ্য ভাষাসন্তানের ভালোবাসা অনেক সময় প্রকাশিত হয় না শব্দে, হয় না আচরণে, কিন্তু তা হৃদয়ের গভীরে সযত্নে লুকিয়ে থাকে।ছোটবেলায় মায়ের আঁচল ধরেই পৃথিবীকে চিনতাম আমরা।তারপর ধীরে ধীরে হাত ছেড়ে আমরা সামনে এগিয়ে যাই, কিন্তু মায়ের মুখখানি রয়ে যায় আমাদের পিছনে—দৃশ্যত নয়, কিন্তু অনুভবে, ছায়ায়, আর অন্তরাত্মায়। বড় হয়ে হয়তো অনেকেই মাকে সময় দিতে পারি না, মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে পারি না, কিন্তু নিঃসন্দেহে যখন একা থাকি, ক্লান্ত থাকি, ব্যর্থতার ভারে ভেঙে পড়ি—তখন মনে হয়, “ইশ্, মা যদি পাশে থাকতো!”সেই মুহূর্তে আমরা বুঝি—এই দুনিয়ায় মায়ের বিকল্প নেই, হবেও না। মা দিবস—একটি ক্ষণিক উপলক্ষ, একটি চিরন্তন ভালোবাসার কথা স্মরণহ্যাঁ, মা দিবস একটি প্রতীক। এটি একটি দিনে সীমাবদ্ধ নয়।মা দিবস আমাদের মনে করিয়ে দেয় সেই অমূল্য আত্মাকে, যাঁর জন্য আমরা আছি।এই দিনটি যেন এক অঙ্গীকার—আমরা যেন কখনো ভুলে না যাই সেই হাতদুটিকে, যারা আমাদের পৃথিবীর সাথে প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। আজকের দিনে, আসুন আমরা শুধু মাকে একটি ফুল উপহার দিয়ে দায়িত্ব শেষ না করি।আসুন আমরা তাঁর পাশে বসি, তাঁর গল্প শুনি, তাঁর চোখে চোখ রাখি, আর মৃদু হেসে বলি—“মা, তোমার মতো কেউ নেই, কখনো ছিল না, কখনো হবেনা।”শেষ কথন: মায়ের জন্য কিছু শব্দ “তুমি আছো বলেই আকাশটা এখনো নীল,তোমার হাসি মানেই জীবনের চাবিকাঠি।তুমি কাঁদলে মন ভেঙে পড়ে,তুমি হাসলে পৃথিবী আলোয় ভরে।

মা, তুমি আছো বলেই আকাশটা এখনো নীল Read More »

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: এক কবির জীবনের শতরঙা ছায়াচিত্র Angan

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: এক কবির জীবনের শতরঙা ছায়াচিত্র

যদি বলেন, বাংলা সাহিত্য কার কাছে সবচেয়ে বেশি ঋণী—একটি নামই কানে বাজবে: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তবে তিনি শুধু কবি নন। তিনি যেন এক সত্তা—যাঁর হৃদয়জুড়ে ছিল সঙ্গীত, শিল্প, দর্শন, প্রেম, প্রতিবাদ, ও মানবতা। তাঁর কলমে ফুটে উঠেছে মানুষের গভীরতম আবেগ, প্রকৃতির মর্মসন্ধান, ও বিশ্বচেতনায় বিশ্বাস।একটা জীবন যা কখনও সাহিত্য, কখনও গান, কখনও শিক্ষা, আবার কখনও প্রতিবাদের ভাষা হয়ে উঠেছিল। জন্ম ও শৈশব: কাব্যিক এক সূচনা১৮৬১ সালের ৭ই মে, কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্ম হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। এক সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিজীবী পরিবারে জন্ম নিয়ে ছোটবেলা থেকেই তিনি গড়ে উঠেছিলেন এক স্বতন্ত্র মানসিকতায়।বাড়ির চারপাশে ছিল সংগীত, নাটক, সাহিত্য, ধর্ম ও দার্শনিক চর্চার এক অনন্য পরিবেশ। পুঁথিগত বিদ্যার বেড়াজাল ভালো লাগেনি রবির। বরং প্রকৃতি, ভাবনা, ও নিজের চিন্তার জগতে হারিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। সাহিত্য জীবনের যাত্রা: যখন শব্দ হয়ে ওঠে আত্মামাত্র ১৬ বছর বয়সে “ভানুসিংহ” ছদ্মনামে প্রকাশ পায় তাঁর প্রথম কবিতা। এরপর একের পর এক সৃষ্টি—‘সোনার তরী’, ‘চিত্রাঙ্গদা’, ‘শেষের কবিতা’, ‘গীতাঞ্জলি’—প্রেম, দর্শন, দেশপ্রেম, আত্মজিজ্ঞাসা, আর বিশ্বমানবতার এক অপূর্ব কাব্যিক উপাখ্যান। বিশ্ববাসীর হৃদয় ছুঁয়ে যায় তাঁর লেখা। ১৯১৩ সালে, ‘গীতাঞ্জলি’-র ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি পান নোবেল সাহিত্য পুরস্কার—প্রথম এশীয় হিসেবে। বিশ্ব তখন জানতে শেখে এক নতুন কণ্ঠস্বর—যে পূর্বের আলোকে পাশ্চাত্য মনন জাগাতে পারে। রবীন্দ্রসঙ্গীত: হৃদয়ের সুরতাঁর গান—রবীন্দ্রসঙ্গীত—হয়তো বাংলা সংস্কৃতির আত্মা। প্রেম, বেদনা, পূজা, প্রকৃতি, আর দেশপ্রেম—সব অনুভবই তিনি গানে গানে গেঁথেছেন।আজও, সকালবেলার ‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে’ থেকে শুরু করে একলা পথচলার ‘একলা চলো রে’—তাঁর সুরগুলো শুধু গান নয়, বাঙালির জীবনের আবহ। চিত্রশিল্পী রবীন্দ্রনাথপ্রায় ৬৭ বছর বয়সে, রবীন্দ্রনাথ হাতে তুলে নেন তুলি। তাঁর আঁকা ছবি ছিল আধুনিকতায় পূর্ণ, বিমূর্ত ও অভিব্যক্তিশীল। ইউরোপের আর্ট গ্যালারিগুলিতেও তাঁর চিত্রকর্ম প্রদর্শিত হয়েছে।এই মানুষটি যেন চিরন্তন শিখরে পৌঁছাতে জানতেন—যে পথই হোক না কেন। শিক্ষার নতুন দিগন্ত: শান্তিনিকেতনের স্বপ্নএকটি ‘খোলা আকাশের নিচে বিদ্যালয়’—এই ভাবনায় ১৯০১ সালে প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিনিকেতন। পরে ১৯২১-এ সেটি রূপ নেয় বিশ্বভারতীতে—এক আন্তর্জাতিক মানসিকতা সম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে সংস্কৃতি ও জ্ঞান মিলেমিশে এক বিশ্বজোড়া পরিবার গড়ে তোলে। প্রতিবাদ ও রাজনীতি: কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠা এক কবিযদিও তিনি রাজনীতিক ছিলেন না, তবুও তাঁর কলম ছিল প্রতিবাদের ধারালো অস্ত্র। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি ত্যাগ করেন ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া নাইটহুড। তাঁর সেই চিঠি ছিল নৈতিকতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।তিনি ছিলেন ‘দেশপ্রেমিক’—কিন্তু সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের বিরোধী। তাঁর দর্শন ছিল বিশ্বমানবতার, সার্বজনীনতায় বিশ্বাস। ১৯৪১ সালের ৭ই আগস্ট, জোড়াসাঁকোতেই পরিণতি পায় রবীন্দ্রজীবনের মহাকাব্য। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি—তাঁর গান, কবিতা, নাটক, ছবি—আজও বেঁচে আছে আমাদের হৃদয়ে, আমাদের ভাষায়, আমাদের চেতনায়।দুই দেশের জাতীয় সংগীত তাঁর কলমেরই সৃষ্টি—‘জনগণমন’ (ভারত) ও ‘আমার সোনার বাংলা’ (বাংলাদেশ)—আর কী চাই একজন কবির জীবন থেকে? এখনও আমরা তাঁর আলোয় হাঁটিরবীন্দ্রনাথের জীবন মানে কেবল পুরস্কার বা খ্যাতি নয়। তাঁর জীবন মানে প্রশ্ন করার সাহস, ভালোবাসার গভীরতা, প্রকৃতির প্রতি টান, ও মানুষের প্রতি নিঃস্বার্থ আস্থা।আজও যখন গ্রীষ্মে ‘বৃষ্টির গান’ শুনি, কিংবা বসন্তে ‘ফাগুনের গন্ধ’ পাই, মনে হয়—রবীন্দ্রনাথ আমাদের সাথেই আছেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: এক কবির জীবনের শতরঙা ছায়াচিত্র Read More »

জহির রায়হান: এক ক্যামেরাধারীর বিদ্রোহ - Angan

জহির রায়হান : এক ক্যামেরাধারীর বিদ্রোহ

বাংলাদেশের সাহিত্য ও চলচ্চিত্র ইতিহাসে জহির রায়হান কেবল একটি নাম নন—তিনি এক ঝড়। তিনি এমন একজন শিল্পী, যিনি শব্দে, ক্যামেরায় ও হৃদয়ে বিদ্রোহের ছবি এঁকেছেন। তাঁর জীবন ছিল এক অসমাপ্ত কবিতা, যার প্রতিটি চরণ ছিল স্বপ্ন ও স্বদেশের প্রতি একাগ্র প্রেম। ১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট, ফেনীর মধুপুর গ্রামে জন্ম। শৈশব কেটেছে ব্রিটিশ শাসনের অন্তিম লগ্নে। দেশভাগের কালো ছায়া যখন এপার-ওপারকে বিভক্ত করে দিচ্ছিল, তখনই এক কিশোর মনের ভেতর গেঁথে নিচ্ছিল মানুষের কান্না, দুর্ভিক্ষ, অপমান, বিদ্রোহ—আর এসবই পরে পরিণত হয় তার সৃষ্টিশক্তির খোরাকে। সাহিত্য থেকে সিনেমা: এক দ্বৈতজাগতিক অভিযাত্রাজহির রায়হান তাঁর সৃষ্টিপথ শুরু করেন কথাসাহিত্যের মাধ্যমে।‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘হাজার বছর ধরে’—প্রতিটি গ্রন্থ ছিল যেন জাতির মনের আয়না। তবে কলমই যথেষ্ট ছিল না। সময় ডাক দিচ্ছিল আরো সরাসরি কিছুর—সিনেমা। ১৯৬১ সালে তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ মুক্তি পায়। পরিণতিস্বরূপ, তিনি হয়ে ওঠেন পূর্ব বাংলার সিনেমা আন্দোলনের পথিকৃৎ। তবে চূড়ান্ত বিস্ফোরণ আসে ১৯৭০ সালে, তাঁর অনন্য সৃষ্টি ‘জীবন থেকে নেয়া’ দিয়ে। জীবন থেকে নেয়া: এক পরিবার, এক জাতির প্রতিচ্ছবিএই চলচ্চিত্র এক কল্পিত পরিবারের গল্প হলেও বাস্তবে ছিল পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার নগ্ন রূপের প্রতীকী ভাষ্য। ঘরের এক নারীর একনায়কতন্ত্র প্রতিফলিত করছিল রাষ্ট্রের দমননীতি। হারমোনিয়ামের একঘেয়ে বাজনা প্রতীকেরূপে হাজির হয় দুঃসহ শাসনের।চায়ের কাপ কেড়ে নেওয়া—স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ।কারাবন্দি ভাইয়েরা—এক শৃঙ্খলিত জাতির রূপ। এই চলচ্চিত্র ছিল বিপ্লবী। সেন্সর বোর্ডে বাধা পেয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছিল। অথচ এই চলচ্চিত্রই বাংলার মানুষের চোখে এক নতুন আলোর জন্ম দিয়েছিল—চলচ্চিত্রও হতে পারে প্রতিবাদের ভাষা। স্টপ জেনোসাইড: যখন ক্যামেরা হয়ে ওঠে অস্ত্র১৯৭১, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের কালপর্ব। জহির রায়হান তখন আর শুধু শিল্পী নন, এক সৈনিক—ক্যামেরা তাঁর অস্ত্র। ভারতের শরণার্থী শিবিরে গিয়ে যা দেখলেন, তা বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য তৈরি করলেন তথ্যচিত্র—‘Stop Genocide’।এই ২০ মিনিটের ডকুমেন্টারি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে এক অনন্য প্রতিবাদ। এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে এক প্রধান ভূমিকা রাখে। এই চলচ্চিত্রে তিনি বলেছিলেন:“They showed what we are not. So I must show what we are.” এক নিঃশব্দ অন্তর্ধান১৯৭১ সালের বিজয়ের পরও জহির রায়হান ছিলেন স্বজনহারা। তাঁর বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার, একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক, রাজাকারদের হাতে অপহৃত হন। ১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি, ভাইয়ের খোঁজে বের হন জহির। সেদিনই হারিয়ে যান চিরতরে।ধারণা করা হয়, তিনি হত্যা হন পাকিস্তান-অনুগত আলবদর বাহিনীর হাতে। তাঁর মৃতদেহ আজও মেলেনি। বাংলাদেশ পেয়েছিল স্বাধীনতা, হারিয়েছিল তার এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। মৃত্যুর পর, যে জীবন প্রবাহিতজহির রায়হানের মৃত্যু হয়নি—তিনি জীবিত, তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রে, গল্পে, দর্শনে। তাঁর উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ আজও বাংলাসাহিত্যের এক মহাকাব্য।‘স্টপ জেনোসাইড’ এখনও নথিভুক্ত হয় গণহত্যা প্রতিরোধের অন্যতম তথ্যচিত্র হিসেবে।তরুণ প্রজন্ম তাঁর চলচ্চিত্র ও সাহিত্য থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে পায়। ১৯৯৯ সালে তাঁর ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে Stop Genocide আবার প্রদর্শিত হয়—তাঁর ক্যামেরার আলো আবারও জ্বলে ওঠে। জহির রায়হান আছেন—থাকবেনপ্রতিবার কোনো চলচ্চিত্রকার যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্যামেরা তোলে, জহির রায়হান সেখানে থাকেন।প্রতিবার যখন কোনো তরুণ লেখক নিজের কলমে তুলে আনে রাজনীতি ও আবেগের মিশ্রণ, তিনি সেখানে থাকেন। তিনি ছিলেন এক সত্যের সাধক, যার ক্যামেরা কাঁপিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্রকে।তিনি ছিলেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা, যার মৃত্যুও তাঁকে থামাতে পারেনি। সূত্র ও সুপারিশযোগ্য পাঠ/দর্শন:জীবন থেকে নেয়া (চলচ্চিত্র, ১৯৭০)স্টপ জেনোসাইড (তথ্যচিত্র, ১৯৭১)হাজার বছর ধরে (উপন্যাস)দ্য ডেইলি স্টার-এর জহির রায়হান বিষয়ক প্রবন্ধবাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটির শিক্ষা উপকরণYouTube-এ “Zahir Raihan Tells About Paki Propaganda”

জহির রায়হান : এক ক্যামেরাধারীর বিদ্রোহ Read More »

Scroll to Top