এলিফ শাফাকের সাক্ষাৎকার: “আমি নিঃস্বরদের কথাই বলি”
প্রশ্ন: ছোটবেলায় পড়া এমন একটি বইয়ের কথা বলুন যা আপনাকে খুব টেনেছিল। কোন দিকটা আপনার কল্পনাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, এবং সেটি কি এখনো আপনার সঙ্গে রয়ে গেছে? এলিফ শাফাক: আ টেল অব টু সিটিজ। তখন গ্রীষ্মকাল। আমার নানী আমাকে ইজমিরে নিয়ে গিয়েছিলেন এবং সেখান থেকে আমাকে আমার দাদীর বাড়িতে রেখে গিয়েছিলেন যেন আমি বহু বছর পর আমার বাবার সঙ্গে দেখা করতে পারি। এক ধরনের অদ্ভুত, বিষণ্ণ ও একাকী গ্রীষ্ম ছিল সেটা।তখনই আমি প্রথম চার্লস ডিকেন্সের বই পড়ি, কারণ এই বইটি তখনই প্রথমবার তুর্কি ভাষায় গ্রাফিক নভেল হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। পুরো গ্রীষ্মজুড়ে আমি এই বইটি বহুবার পড়েছি, সব ছবি রঙ করে ফেলেছিলাম—বনেট, বাড়ি, মদের পিপে, গিলোটিন। ডিকেন্স আমার বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। প্রশ্ন: এমন কোনো বইয়ের কথা বলুন যা আপনাকে লেখক হতে প্রেরণা জুগিয়েছে। কীভাবে সেটি আপনার সৃজনশীল যাত্রা শুরু করতে সাহায্য করেছিল? লেখক হিসেবে আপনার ভঙ্গি বা আকাঙ্ক্ষায় কী প্রভাব ফেলেছিল? এলিফ শাফাক: ডন কিহোতে—মিগেল দে সারভান্তেসের লেখা। যখন আমি প্রথম মাদ্রিদে এটি পড়ি, তখন আমি কিশোরী। সেই বই আমাকে নাড়িয়ে দিয়েছিল, অনুপ্রাণিত করেছিল, এবং আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছিল।আমি এমন এক পরিবেশে বড় হয়েছি যেখানে মৌখিক গল্প বলার ঐতিহ্য ছিল—মধ্যপ্রাচ্য, বলকান, এশিয়া মাইনরের। গল্পগুলো ছিল বৃত্তাকার, সময় ও স্থানের বাইরে ভেসে বেড়াত। কিন্তু ডন কিহোতে আমাকে প্রথমবারের মতো উপন্যাসের এক বিস্ময়কর কাঠামোর সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়—একসঙ্গে অনেক স্তর, অনেক আবেগ, হাসি থেকে শুরু করে বিষণ্ণতা পর্যন্ত। এটি এমন এক গল্প বলার ধরন যা কল্পনা, সাহস, জ্ঞান এবং অন্তর্দৃষ্টিকে একসাথে বুনে ফেলে।এটি ছিল এক বই যা বইকে ভালোবাসে! এক বই যা পাঠ এবং সাহসের কথা বলে! আমি জীবনের বিভিন্ন সময়ে এই বই আবার পড়েছি এবং প্রতিবার আমার অভিজ্ঞতা নতুনভাবে জন্ম নিয়েছে। এটি আমাকে লেখক হিসেবে বদলে দিয়েছে, কিন্তু তার চেয়েও আগে আমাকে একজন পাঠক হিসেবে বদলে দিয়েছে। প্রশ্ন: আপনার সর্বকালের প্রিয় উপন্যাস কোনটি? কীভাবে তা আপনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে? আপনি কি সাম্প্রতিককালে আবার সেটি পড়েছেন? এলিফ শাফাক: এখানে আমি দু’টি উপন্যাসের কথা একসাথে বলতে চাই। একটি হলো ভার্জিনিয়া উলফের Orlando। এই উপন্যাস আমার হৃদয়ে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। এই বই পড়ার আগে আমি জানতাম না যে একজন লেখক হিসেবে আপনি এতটা ঝুঁকি নিতে পারেন—একটি কাহিনী কল্পনা করতে পারেন যা সময়, ভূগোল, সংস্কৃতি, পরিচয়, স্মৃতি—সব সীমা ছাড়িয়ে যায়। পুরো উপন্যাসটা যেন জলের মতো—বয়ে চলে, খোঁজে, রূপান্তরিত হয়। এই উপন্যাস আমার মধ্যে এক গভীর মুক্তির অনুভূতি তৈরি করে।আরেকটি হলো দস্তয়েভস্কির The Brothers Karamazov। এটি একসাথে আবেগময় ও দার্শনিক, অনুভূতিপ্রবণ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক। এটি বিশ্বাস, সংশয়, নৈতিকতা, স্বাধীন ইচ্ছা, ইতিহাস, পরিবার, ব্যক্তি পরিচয় বনাম সামষ্টিক পরিচয়—এমন সব কঠিন বিষয় নিয়ে ভাবায়। আমি ভালোবাসি এই বইয়ের চরিত্রগুলোর বহুমাত্রিকতা এবং এর কাঠামোর জটিলতা—এগুলো কখনোই একরৈখিক নয়, বরং একে অন্যের সঙ্গে গভীরভাবে সংযুক্ত। এই জটিলতা আমাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রশ্ন: আপনার উপন্যাস 10 Minutes 38 Seconds in This Strange World, যা ২০১৯ সালে বুকার পুরস্কারের জন্য শর্টলিস্টেড হয়েছিল, ইস্তানবুলে এক যৌনকর্মীর বাস্তব মৃত্যু দ্বারা অনুপ্রাণিত। এই ঘটনার কোন দিকটি আপনাকে উপন্যাস লিখতে বাধ্য করল? এবং কেন আপনি প্রায়ই সমাজের প্রান্তিক মানুষদের নিয়েই লেখেন? এলিফ শাফাক: একজন লেখক হিসেবে আমি শুধু গল্প ও গল্প বলার ধরনেই আগ্রহী নই, আমি সেই নীরবতা আর নিঃশব্দতার দিকেও আকৃষ্ট হই—যারা সমাজে অবদমিত, যাদের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। আমি সবসময় ভাবি, আমার সমাজে সেই নিঃশব্দ অঞ্চলগুলো কোথায়? আর কাদের কণ্ঠ স্তব্ধ করে রাখা হয়েছে? ইস্তানবুলে একটা কবরস্থান আছে যেখানে আমি মাঝেমাঝে যেতাম—এর নাম সঙ্গীহীনদের কবরস্থান (The Cemetery of the Companionless)। বিগত কয়েক বছরে এটি দ্রুত বেড়ে উঠেছে। বিশাল এক জায়গা। এখানে সমাজ থেকে বর্জিত মানুষদের সমাধিস্থ করা হয়—যৌনকর্মী, এইচআইভি-সম্পর্কিত রোগে মৃত ব্যক্তিরা, আত্মহত্যাকারী, এমন অভিবাসীরা যারা ইউরোপে পৌঁছাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন… এরা সবাই এখানে পাশাপাশি শুয়ে আছেন। তাদের কবরে কোনো নাম নেই, শুধু নম্বর। এটা এমন এক জায়গা, যেখানে একজন মানুষকে নাম থেকে সরিয়ে সংখ্যা বানিয়ে ফেলা হয়, গল্পকে স্তব্ধ করে ফেলা হয়। আমার উপন্যাসে আমি সেটাকেই উল্টে দিতে চেয়েছি—উল্টো করে দেখতে চেয়েছি। আমি চাইছিলাম ঐ কবরে লেখা নম্বরগুলোর মধ্যে একটা বেছে নিয়ে তাকে একটা নাম দিতে, একটা গল্প দিতে, কিছু বন্ধু দিতে, যেন মানবতাহীনতার সেই প্রক্রিয়াটাকে ফেরত নেওয়া যায়। প্রশ্ন: 10 Minutes… উপন্যাসে মানবাধিকার, লিঙ্গ, যৌনতা ও প্রান্তিকতার মতো সামাজিক বিষয় উঠে এসেছে। আপনি কীভাবে মনে করেন, কথাসাহিত্য এই ধরনের বিষয়গুলোকে স্পর্শ করতে পারে বা ভূমিকা রাখতে পারে? এলিফ শাফাক: গল্প বলার শিল্প peripheral বা প্রান্তিকতাকে কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসতে পারে। অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করতে পারে, অস্ফুট কণ্ঠকে কিছুটা শোনা যেতে দিতে পারে। আমি এমন এক দেশ থেকে এসেছি, যেখানে সামাজিকভাবে সামষ্টিক বিস্মৃতির (collective amnesia) প্রবণতা অনেক গভীর। তুরস্কের ইতিহাস দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ হলেও স্মৃতি ঠিক ততটা শক্তিশালী নয়। বরং উল্টোটা—ইতিহাস প্রায় সবসময় পুরুষদের গল্প হয়, ক্ষমতাবান পুরুষদের গল্প। তা কখনোই ‘her-story’ বা নারীদের গল্প নয়। গরিব বা সংখ্যালঘু পুরুষদের গল্পও নয়।আপনি যখন প্রশ্ন তুলবেন—এই গল্পটা কে বলছে? এবং কাকে বলতে দেওয়া হয়নি? তখন পুরো দৃশ্যটাই বদলে যায়। একজন ঔপন্যাসিক হিসেবে আমি সেই অনকথিত গল্পগুলোতে আগ্রহী—নারীদের গল্প, সংখ্যালঘুদের গল্প, যেগুলো ‘সুবিধাজনকভাবে’ ভুলে যাওয়া হয়েছে বা মুছে ফেলা হয়েছে এইসব বিষয় সহজ নয়, এগুলো নিয়ে লিখলে অনেক সমালোচনা, এমনকি আক্রমণও আসে। কিন্তু উপন্যাস হল এমন এক সাহিত্যের ধরন যেখানে রয়েছে সূক্ষ্মতা, বহুমাত্রিকতা, সহানুভূতি—এটি যেন নির্বাসনের মধ্যে এক আশ্রয়, এক দরকারি আশ্রয়স্থল। প্রশ্ন: 10 Minutes… উপন্যাসে স্থান বা লোকালয়ের ভূমিকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইস্তানবুল সেখানে এক শক্তিশালী পটভূমি হিসেবে এসেছে—তার গন্ধ, শব্দ, রং, অনুভবসহ। আপনার লেখায় এই ‘স্থানচেতনা’ কতটা জরুরি? এলিফ শাফাক: স্থান আমার কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ। একজন অভিবাসী লেখক হিসেবে, আমি প্রায়ই ‘অন্তর্ভুক্তি’ আর ‘বহির্ভুক্তি’র বিষয়ে ভাবি। বাস্তবতা হলো—আমরা কি একের অধিক ঘর বা পরিচয়ে থাকতে পারি? এই পৃথিবীতে, যেখানে আমাদের একটি নির্দিষ্ট ঘর বা শ্রেণিতে আটকে দেওয়া হয়, সেখানে কি আমরা একসঙ্গে বহুজাতিক বা বহুস্থানীয় হতে পারি?এই প্রশ্নগুলো আমার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবন আমাকে শিখিয়েছে, আপনি আপনার জন্মভূমি থেকে শারীরিকভাবে অনেক দূরে থাকলেও, মানসিকভাবে তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান না। আমরা আমাদের মাতৃভূমিকে বয়ে বেড়াই—যেখানেই যাই না কেন।তাতে একটা বেদনাবোধ থাকে, ক্ষয়বোধ। একইসাথে, যুক্তরাজ্য এখন আমার ঘর হয়ে উঠেছে। এমনকি ইংরেজি ভাষাটাও। আমি আমার মাতৃভাষা ছেড়ে একটি ভিন্ন ভাষায় লিখি।তাই আমার জন্য স্থান, শেকড়, পরিচয়—সবকিছুই জটিল এক অভিজ্ঞতা। প্রশ্ন: আপনার অনেক উপন্যাসেই ‘ম্যাজিকাল রিয়ালিজম’ বা জাদুবাস্তবতার উপাদান লক্ষ করা যায়। আপনি এই শৈলীতে এতটা আগ্রহী কেন? এবং কোন লেখকরা আপনাকে এই ঘরানায় প্রভাবিত করেছেন? এলিফ শাফাক: আমি Gabriel Garcia Marquez, Toni Morrison কিংবা Jorge Luis Borges-এর মতো লেখকদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রাখি—যারা জাদুবাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তারা প্রত্যেকে আমার ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছেন।তবে আমি মনে করি, আমাদের এই ‘ম্যাজিকাল রিয়ালিজম’ নামক শ্রেণিবিভাগটাকেও
এলিফ শাফাকের সাক্ষাৎকার: “আমি নিঃস্বরদের কথাই বলি” Read More »