আমি কেন লিখি – জর্জ অরওয়েল - angan

আমি কেন লিখি – জর্জ অরওয়েল

আমরা আমাদের আনন্দগুলোকে পঙ্গু করে ফেলি কিংবা লুকিয়ে রাখি; ঘোড়াগুলো তৈরি হয়েছে ক্রোমিয়াম স্টিল দিয়ে, আর সেগুলোর পিঠে চড়ে বসে ছোট ছোট মোটা মানুষগুলো। আমি সেই কেঁচো, যে কখনও ফোটে না, আমি সেই খোজা, যার কোনো হারেম নেই; যাজক আর কমিশনারের মাঝখানে আমি হাঁটি ইউজিন আরামের মতো; আর কমিশনার আমার ভাগ্য গণনা করছেন যখন রেডিওটা বাজছে, কিন্তু যাজক আমাকে একখানা অস্টিন সেভেন গাড়ির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, কারণ ডাগি সবসময় টাকা শোধ করে। আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম, আমি মার্বেল প্রাসাদে বাস করছি, আর জেগে উঠে দেখলাম, সত্যি তাই; আমি এই সময়ের জন্য জন্মাইনি; স্মিথ কি জন্মেছিল? জোন্স? আপনি? স্প্যানিশ যুদ্ধ এবং ১৯৩৬-৩৭ সালের অন্যান্য ঘটনাগুলো আমার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দেয়। এরপর থেকে আমি জানতাম আমি কোথায় দাঁড়িয়ে আছি। ১৯৩৬ সালের পর থেকে আমি যতগুলো গুরুত্বপূর্ণ লেখা লিখেছি, সবই কোনো না কোনোভাবে একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে এবং গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রের পক্ষে লেখা। আমাদের এই সময়ে, এরকম বিষয় এড়িয়ে গিয়ে লেখালেখি করা একধরনের নির্বোধতা। সবাই এসব নিয়েই লেখে—কেউ সরাসরি, কেউ পরোক্ষভাবে। প্রশ্নটা হলো, কে কোন পক্ষ নেয় এবং কোন পদ্ধতি অনুসরণ করে। আর কেউ যদি নিজের রাজনৈতিক পক্ষপাত সম্পর্কে সচেতন থাকে, তাহলে সে তুলনামূলকভাবে বেশি সুযোগ পায় রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হতে—তাও আবার তার নান্দনিক ও বৌদ্ধিক সততা বজায় রেখেই।গত দশ বছরে আমি যা করতে চেয়েছি, তা হলো রাজনৈতিক লেখাকে একধরনের শিল্পে রূপান্তর করা। আমার শুরুটা সবসময় পক্ষপাত থেকে হয়—একটা অন্যায়ের অনুভব থেকে। যখন আমি একটা বই লিখতে বসি, তখন ভাবি না, “আমি একটা শিল্পকর্ম তৈরি করতে যাচ্ছি।” আমি লিখি কারণ কোনো মিথ্যে আমি ভেঙে দিতে চাই, কোনো সত্যের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। আমার প্রাথমিক উদ্দেশ্য থাকে—শ্রোতাকে পাওয়া। তবে একটা বই লিখতে পারতাম না, এমনকি একটা দীর্ঘ প্রবন্ধও না, যদি সেটা নান্দনিক অভিজ্ঞতা না হতো। কেউ যদি আমার লেখাগুলো খেয়াল করে দেখে, তাহলে বুঝবে—এমনকি যখন লেখাটা সরাসরি প্রোপাগান্ডা, তখনও তাতে এমন অনেক কিছু থাকে যা একজন পেশাদার রাজনীতিক অপ্রাসঙ্গিক মনে করতেন। আমি পারি না, আর চাইও না, শৈশবে অর্জিত দৃষ্টিভঙ্গিটা পুরোপুরি বাদ দিতে। আমি যতদিন বেঁচে থাকব, ততদিন ভালো গদ্যরীতির প্রতি আগ্রহ থাকবে, পৃথিবীর রূপের প্রেমে থাকব, আর কঠিন বস্তুর প্রতি আকর্ষণ ও নিরর্থক তথ্যে মজা পাব। সেই দিকটা দমন করা বৃথা। কাজ হলো—এই ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দগুলোকে এমন এক সময়ের প্রয়োজনের সঙ্গে মেলানো, যা আমাদের প্রত্যেককেই ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ত্যাগ করে সামষ্টিক হয়ে উঠতে বাধ্য করে। এটা সহজ নয়। এটা নির্মাণশৈলী ও ভাষার সমস্যার সৃষ্টি করে, এবং সত্য বলার এক নতুন রকমের সমস্যাও তোলে। একটা উদাহরণ দিই—যেটা সরল ধরনের সমস্যা। আমার স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ নিয়ে লেখা বই Homage to Catalonia, এটা নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক বই, তবে আমি চেষ্টা করেছি নিরপেক্ষতা ও শৈল্পিক গুণ বজায় রেখে লিখতে। তাতে একটা দীর্ঘ অধ্যায় আছে, যেটা পত্রিকার উদ্ধৃতি দিয়ে ভরপুর, যেখানে ট্রটস্কিপন্থীদের পক্ষে যুক্তি দেওয়া হয়েছে—যারা তখন ফ্রাঙ্কোর সঙ্গে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত ছিল। এই অধ্যায়টা, যা দু-এক বছরের মধ্যে সাধারণ পাঠকের কাছে আগ্রহ হারাবে, অবশ্যই বইটাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। একজন সমালোচক, যাকে আমি সম্মান করি, আমাকে একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন।বলেছিলেন, “তুমি এত সব তথ্য দিয়েছ কেন? তুমি যা একটা ভালো বই হতে পারত, সেটা সাংবাদিকতায় নামিয়ে এনেছ।” উনি ঠিকই বলেছিলেন, কিন্তু আমি অন্যভাবে পারতাম না। কারণ আমি জানতাম—যা খুব কম ইংরেজ জানত—নির্দোষ মানুষদের মিথ্যা অভিযোগে ফাঁসানো হচ্ছিল। আমি যদি ও নিয়ে রাগ না করতাম, তাহলে আমি বইটা লিখতাম না। এই ধরণের সমস্যা বারবার ফিরে আসে। ভাষার সমস্যা আরও সূক্ষ্ম, এবং সেটা আলোচনার জন্য অনেক সময় লাগবে। শুধু এতটুকু বলি—গত কয়েক বছরে আমি চেষ্টা করেছি কম চিত্রকল্প ব্যবহার করে বেশি নির্ভুলভাবে লিখতে। আর একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি—যখনই তুমি কোনো লেখার ধরন নিখুঁত করো, তখনই সেটা পুরনো হয়ে যায়। Animal Farm ছিল প্রথম বই যেখানে আমি পুরোপুরি সচেতনভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য আর শৈল্পিক উদ্দেশ্যকে এক করে ফেলার চেষ্টা করেছিলাম। আমি সাত বছর ধরে উপন্যাস লিখিনি, তবে আশা করি শিগগিরই আবার লিখব। সেটা ব্যর্থ হবেই—সব বই-ই কোনো না কোনোভাবে ব্যর্থ হয়—তবে আমি এখন বেশ পরিষ্কার জানি, কী ধরণের বই আমি লিখতে চাই। শেষ দুই পৃষ্ঠার দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখি, যেন বোঝানো হয়েছে, লেখার পেছনে আমার উদ্দেশ্য পুরোপুরি জনকল্যাণমুখী। আমি সেটা চূড়ান্ত বার্তা হিসেবে দিতে চাই না। সব লেখকই আত্মকেন্দ্রিক, অলস আর অহংকারী, এবং সব কিছুর গভীরে এক রহস্যময় প্রেরণা কাজ করে। একটা বই লেখা মানে হলো—একটা দীর্ঘ, ক্লান্তিকর অসুস্থতার মতো সংগ্রাম। কেউ কখনও এটা করত না, যদি না তার মধ্যে এমন কোনো অসাধ্য শক্তি থাকত, যাকে ঠেকানো যায় না, যাকে বোঝাও যায় না। এই শক্তিটা হয়তো সেই একই প্রবৃত্তি, যার কারণে একটা শিশু কেঁদে উঠে মনোযোগ চায়। অথচ এ-ও সত্যি যে, লেখার সময় যতটা সম্ভব নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে না পারলে, কেউই কিছু পাঠযোগ্য লিখতে পারে না। ভালো গদ্য হলো একখানা পরিষ্কার জানালার মতো। আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি না কোন উদ্দেশ্য আমার মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী, তবে জানি—কোনগুলো অনুসরণ করার মতো। আমার লেখাগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখি, যেখানে আমার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অনুপস্থিত ছিল, সেখানেই আমি প্রাণহীন লিখেছি—সেইসব লেখায় ছিল অস্পষ্ট বাক্য, অকারণ অলঙ্কার, সাজানো শব্দ আর এক ধরণের ভণ্ডামি। Source : Gangrel, No. 4, Summer 1946

আমি কেন লিখি – জর্জ অরওয়েল Read More »