প্রযুক্তির দুনিয়ায় কাজ করতে করতে আমরা প্রতিদিনই বিভিন্ন অ্যালগরিদম, কোড, সমীকরণ, মানচিত্র, সময়সূচি নিয়ে কাজ করি। কিন্তু কজন জানি—এই সব কিছুর ভিত্তি তৈরি করে গেছেন এক হাজার বছর আগের এক মুসলিম পণ্ডিত?

একজন মুসলমান, একজন গবেষক, একজন চিন্তাবিদ, একজন শিক্ষক এবং একজন পথপ্রদর্শক। তাঁর নাম—মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খাওয়ারিজমি।

এক বিস্ময়কর জন্ম
খাওয়ারিজম—একটা অঞ্চল যার নাম আজ অনেকেই জানে না। এটি বর্তমান উজবেকিস্তানের অন্তর্গত। সেই ছোট্ট এক অঞ্চলে আনুমানিক ৭৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম নিয়েছিলেন মুহাম্মদ ইবনে মুসা। তাঁর নামেই যুক্ত হয়েছে “আল-খাওয়ারিজমি”—অর্থাৎ “খাওয়ারিজম থেকে আগত”।

তার শৈশব বা পরিবার নিয়ে খুব বেশি তথ্য নেই, তবে আমরা অনুমান করতে পারি তিনি একজন শিক্ষিত পরিবারের সন্তান ছিলেন। আর সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি ছিলেন কৌতূহলী। ঠিক যেন সেইসব শিশুর মতো, যারা প্রতিটা জিনিস খুলে দেখে—কেন কীভাবে কাজ করছে।

বাগদাদ: জ্ঞানের স্বর্গে পথচলা
যুবক বয়সে আল-খাওয়ারিজমি পাড়ি দেন সেই সময়ের জ্ঞানের রাজধানী—বাগদাদে। আর বাগদাদ মানেই তখন “হাউস অব উইজডম” বা বায়তুল হিকমা—যেখানে গ্রীক, পারস্য, ভারতীয়, সিরিয়ান, এবং রোমান জ্ঞান একসাথে অনুবাদ হচ্ছিল আরবি ভাষায়। সেই স্থানে গবেষক হিসেবে যোগ দেন তিনি।

তিনি সেখানে কাজ করতেন শুধু বই পড়ার জন্য নয়—নিজেই নতুন কিছু ভাবার জন্য। তিনি অনুবাদ করেছেন, গবেষণা করেছেন, আবার নিজের মতো করে চিন্তাকে গড়ে তুলেছেন।

বীজগণিতের জন্ম: “আল-জাবর”-এর আলোয়
যে বইটি তাঁকে ইতিহাসে অমর করে তুলেছে, তা হলো—
“আল-কিতাব আল-মুখতাসার ফি হিসাব আল-জাবর ওয়াল-মুকাবালা”।
এটি শুধু একটি গণিত বই নয়—এটি একটি দার্শনিক গ্রন্থ।

এই বইয়ে তিনি এমনভাবে অজানা সমস্যাগুলোকে সমীকরণের আকারে ব্যাখ্যা করেছেন, যেন একজন গল্পকার সমস্যার কাঠামো গড়ে তোলেন।

“আল-জাবর” অর্থ ‘পুনঃস্থাপন’ এবং “মুকাবালা” অর্থ ‘সাম্য তৈরি’—এই দুই পদ্ধতির মাধ্যমে তিনি প্রথমবারের মতো আজকের বীজগণিতের ভিত্তি তৈরি করেন।

সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হলো, তিনি বাস্তব জীবনের সমস্যা নিয়ে কাজ করেছেন—সম্পত্তি বণ্টন, জমির পরিমাপ, উত্তরাধিকার—যা সাধারণ মানুষ সহজেই বুঝতে পারে। তখনকার সময় গণিত ছিল শুধুই পরিমাপের বিজ্ঞান, কিন্তু তিনি সেটাকে চিন্তার ভাষায় রূপান্তর করলেন।

অ্যালগরিদমের পিতা
আপনি যদি প্রোগ্রামার হন, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হন, কিংবা স্রেফ একজন কৌতূহলী প্রযুক্তিপ্রেমী হন—তাহলে জেনে রাখুন, “Algorithm” শব্দটি এসেছে তাঁর নাম থেকেই।

তাঁর অনুবাদিত বইয়ের লাতিন নাম ছিল “Algoritmi de numero Indorum”—অর্থাৎ ‘ভারতীয় সংখ্যাবিদ্যার উপর আল-খাওয়ারিজমির পদ্ধতি’। এই শব্দ থেকেই পরবর্তীতে “Algorithm” শব্দটি গড়ে ওঠে।
ভাবুন তো, আমাদের প্রতিদিনের প্রযুক্তি—গুগল সার্চ, ইউটিউব সাজেশন, ফেসবুক অর্ডার, এমনকি রোগ নির্ণয়ের সফটওয়্যার—সব কিছুর বুনিয়াদ দাঁড়িয়ে আছে এক মুসলিম পণ্ডিতের চিন্তার ওপর!

আকাশ ও পৃথিবীর মানচিত্র: জ্যোতির্বিজ্ঞান ও ভূগোলেও তাঁর অবদান
গণিত তাঁর প্রধান ক্ষেত্র হলেও, তিনি ছিলেন একাধারে জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং ভূগোলবিদ।
তিনি তৈরি করেছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানের সারণি, যা ইবাদতের সময় নির্ধারণ, কিবলার দিক নির্ণয় এবং চাঁদ-সূর্যের গতি বুঝতে কাজে লাগত।

তিনি তৈরি করেছিলেন এক বিশাল মানচিত্র, যাতে প্রায় ২৪০০ স্থানের নাম ও স্থানাঙ্ক ছিল। তাঁর “সুরত আল-আরদ” বইয়ে বিশ্বকে দেখানো হয়েছিল সম্পূর্ণ নতুন এক পদ্ধতিতে।

ইউরোপে তাঁর উত্তরাধিকার: রেনেসাঁর এক অজানা ভিত্তি
১১শ-১২শ শতকে যখন ইউরোপ জ্ঞানের ঘাটতিতে ভুগছিল, তখন তাঁর লেখা বইগুলো স্পেনের মাধ্যমে লাতিন ভাষায় অনূদিত হয়।
তাঁর চিন্তা-চেতনা ইউরোপীয়দের অন্ধকার সময়ে আলোর দিশা দেয়। এক কথায়, আল-খাওয়ারিজমি ছিলেন সেই নিরব কণ্ঠস্বর, যাঁর কথার প্রতিধ্বনি আজও শোনা যায় আমাদের প্রতিটি কোড, প্রতিটি কম্পিউটার এবং প্রতিটি সংখ্যার পেছনে।

তিনি শেখান—গণিত মানে শুধু সংখ্যা না, গণিত হলো বিশ্লেষণ, যুক্তি, সমাধান আর মানবতার কল্যাণ।
তাঁর জীবন দেখিয়ে দেয়—ধর্ম, জাতি, সময় বা স্থান কোনো কিছুই জ্ঞান অর্জনের পথে বাধা নয়। তিনি মুসলমান হয়েও গ্রীক দর্শন, ভারতীয় সংখ্যা পদ্ধতি, পারস্য গণিত—সব কিছুই গ্রহণ করেছেন এবং নিজে কিছু যোগ করেছেন।

আল-খাওয়ারিজমি হয়তো এক হাজার বছর আগের মানুষ। হয়তো তাঁর নাম আমরা পাঠ্যবইয়ের বাইরে খুব একটা শুনি না।
কিন্তু তাঁর চিন্তা, তাঁর পথনির্দেশনা, তাঁর অবদান—আজও আমাদের ঘিরে আছে প্রযুক্তির প্রতিটি পরতে।
তিনি প্রমাণ করে গেছেন—”জ্ঞান কখনো পুরনো হয় না, মানুষ হয়তো চলে যায়, কিন্তু চিন্তা অমর হয়ে থাকে।”

Leave a comment