জহির রায়হান: এক ক্যামেরাধারীর বিদ্রোহ - Angan

বাংলাদেশের সাহিত্য ও চলচ্চিত্র ইতিহাসে জহির রায়হান কেবল একটি নাম নন—তিনি এক ঝড়। তিনি এমন একজন শিল্পী, যিনি শব্দে, ক্যামেরায় ও হৃদয়ে বিদ্রোহের ছবি এঁকেছেন। তাঁর জীবন ছিল এক অসমাপ্ত কবিতা, যার প্রতিটি চরণ ছিল স্বপ্ন ও স্বদেশের প্রতি একাগ্র প্রেম।

১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট, ফেনীর মধুপুর গ্রামে জন্ম। শৈশব কেটেছে ব্রিটিশ শাসনের অন্তিম লগ্নে। দেশভাগের কালো ছায়া যখন এপার-ওপারকে বিভক্ত করে দিচ্ছিল, তখনই এক কিশোর মনের ভেতর গেঁথে নিচ্ছিল মানুষের কান্না, দুর্ভিক্ষ, অপমান, বিদ্রোহ—আর এসবই পরে পরিণত হয় তার সৃষ্টিশক্তির খোরাকে।

সাহিত্য থেকে সিনেমা: এক দ্বৈতজাগতিক অভিযাত্রা
জহির রায়হান তাঁর সৃষ্টিপথ শুরু করেন কথাসাহিত্যের মাধ্যমে।
‘শেষ বিকেলের মেয়ে’, ‘আরেক ফাল্গুন’, ‘হাজার বছর ধরে’—প্রতিটি গ্রন্থ ছিল যেন জাতির মনের আয়না।

তবে কলমই যথেষ্ট ছিল না। সময় ডাক দিচ্ছিল আরো সরাসরি কিছুর—সিনেমা।

১৯৬১ সালে তাঁর পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’ মুক্তি পায়। পরিণতিস্বরূপ, তিনি হয়ে ওঠেন পূর্ব বাংলার সিনেমা আন্দোলনের পথিকৃৎ। তবে চূড়ান্ত বিস্ফোরণ আসে ১৯৭০ সালে, তাঁর অনন্য সৃষ্টি ‘জীবন থেকে নেয়া’ দিয়ে।

জীবন থেকে নেয়া: এক পরিবার, এক জাতির প্রতিচ্ছবি
এই চলচ্চিত্র এক কল্পিত পরিবারের গল্প হলেও বাস্তবে ছিল পাকিস্তানি শাসনব্যবস্থার নগ্ন রূপের প্রতীকী ভাষ্য। ঘরের এক নারীর একনায়কতন্ত্র প্রতিফলিত করছিল রাষ্ট্রের দমননীতি।

হারমোনিয়ামের একঘেয়ে বাজনা প্রতীকেরূপে হাজির হয় দুঃসহ শাসনের।
চায়ের কাপ কেড়ে নেওয়া—স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ।
কারাবন্দি ভাইয়েরা—এক শৃঙ্খলিত জাতির রূপ।


এই চলচ্চিত্র ছিল বিপ্লবী। সেন্সর বোর্ডে বাধা পেয়েছিল, পশ্চিম পাকিস্তানে নিষিদ্ধ হয়েছিল। অথচ এই চলচ্চিত্রই বাংলার মানুষের চোখে এক নতুন আলোর জন্ম দিয়েছিল—চলচ্চিত্রও হতে পারে প্রতিবাদের ভাষা।

স্টপ জেনোসাইড: যখন ক্যামেরা হয়ে ওঠে অস্ত্র
১৯৭১, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের কালপর্ব। জহির রায়হান তখন আর শুধু শিল্পী নন, এক সৈনিক—ক্যামেরা তাঁর অস্ত্র।

ভারতের শরণার্থী শিবিরে গিয়ে যা দেখলেন, তা বিশ্ববাসীকে দেখানোর জন্য তৈরি করলেন তথ্যচিত্র—‘Stop Genocide’।
এই ২০ মিনিটের ডকুমেন্টারি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে এক অনন্য প্রতিবাদ। এটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে এক প্রধান ভূমিকা রাখে।

এই চলচ্চিত্রে তিনি বলেছিলেন:
“They showed what we are not. So I must show what we are.”

এক নিঃশব্দ অন্তর্ধান
১৯৭১ সালের বিজয়ের পরও জহির রায়হান ছিলেন স্বজনহারা। তাঁর বড় ভাই শহীদুল্লাহ কায়সার, একজন খ্যাতনামা সাহিত্যিক, রাজাকারদের হাতে অপহৃত হন।

১৯৭২ সালের ৩০ জানুয়ারি, ভাইয়ের খোঁজে বের হন জহির। সেদিনই হারিয়ে যান চিরতরে।
ধারণা করা হয়, তিনি হত্যা হন পাকিস্তান-অনুগত আলবদর বাহিনীর হাতে। তাঁর মৃতদেহ আজও মেলেনি।

বাংলাদেশ পেয়েছিল স্বাধীনতা, হারিয়েছিল তার এক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে।

মৃত্যুর পর, যে জীবন প্রবাহিত
জহির রায়হানের মৃত্যু হয়নি—তিনি জীবিত, তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রে, গল্পে, দর্শনে।

তাঁর উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ আজও বাংলাসাহিত্যের এক মহাকাব্য।
‘স্টপ জেনোসাইড’ এখনও নথিভুক্ত হয় গণহত্যা প্রতিরোধের অন্যতম তথ্যচিত্র হিসেবে।
তরুণ প্রজন্ম তাঁর চলচ্চিত্র ও সাহিত্য থেকে অনুপ্রেরণা খুঁজে পায়।

১৯৯৯ সালে তাঁর ‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়।
২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে Stop Genocide আবার প্রদর্শিত হয়—তাঁর ক্যামেরার আলো আবারও জ্বলে ওঠে।

জহির রায়হান আছেন—থাকবেন
প্রতিবার কোনো চলচ্চিত্রকার যখন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ক্যামেরা তোলে, জহির রায়হান সেখানে থাকেন।
প্রতিবার যখন কোনো তরুণ লেখক নিজের কলমে তুলে আনে রাজনীতি ও আবেগের মিশ্রণ, তিনি সেখানে থাকেন।

তিনি ছিলেন এক সত্যের সাধক, যার ক্যামেরা কাঁপিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্রকে।
তিনি ছিলেন এক স্বপ্নদ্রষ্টা, যার মৃত্যুও তাঁকে থামাতে পারেনি।



সূত্র ও সুপারিশযোগ্য পাঠ/দর্শন:
জীবন থেকে নেয়া (চলচ্চিত্র, ১৯৭০)
স্টপ জেনোসাইড (তথ্যচিত্র, ১৯৭১)
হাজার বছর ধরে (উপন্যাস)
দ্য ডেইলি স্টার-এর জহির রায়হান বিষয়ক প্রবন্ধ
বাংলাদেশ ওপেন ইউনিভার্সিটির শিক্ষা উপকরণ
YouTube-এ “Zahir Raihan Tells About Paki Propaganda”

Leave a comment